৩৩ বছরেও ঝুঁকিমুক্ত হতে পারেনি উপকূলবাসী
'ভয়াল ২৯ এপ্রিল' আজ
প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
জাবেদ আবেদীন শাহীন, কক্সবাজার
ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ। দেশের ইতিহাসে দুঃসহ স্মৃতিময় একটি দিন। ৩৩ বছর আগে ১৯৯১ সালের এই দিনে কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে 'ম্যারি এন' নামক ভয়াবহতম প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এতে সরকারি হিসেবেই এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবে বেসরকারি হিসাবে সে সময়ে মারা যায় প্রায় ৫ লাখ মানুষ। আকস্মিক সেই ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলে পড়েছিল লাশের মিছিল। সেদিনের সেই ভয়ংকর তান্ডবে শুধু মানুষই নয়, লাখ লাখ গবাদি পশু, ফসল, বিপুল পরিমাণ স্থাপনা, সম্পদ ধ্বংস হয়েছিল। সেদিনের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। অথচ ট্রাজেডির দীর্ঘ সময় পেরিয়েও জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের স্বজন হারানোর আহজারি থামেনি আজও। এখনো স্মৃতিময় দিনটির কথা ভাবতেই ডুকরে কাঁদেন স্বজনহারা উপকূলের মানুষগুলো। আকাশে মেঘ করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার উপকূলবাসী এখনো থাকেন নানা শংকায় আর উৎকণ্ঠায়।
সংশ্লিষ্ট মহল জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া-মহেশখালীসহ প্রায় উপকূলীয় অঞ্চল ও নাগরিক জীবন চরম হুমকির মুখে। যে কোনো সময় কক্সবাজার জেলার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যেতে পারে। যা দেশের ও সরকারের জন্য বড় ধরনের মাথা ব্যথা হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের ৩৩ বছর পরেও উপকূলবাসী ঝুঁকিমুক্ত হতে পারেননি। উপকূলীয় জনপদের মানুষ প্রতিনিয়তই দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করছেন। বর্তমানে যে ডিজাইনে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে তা ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় যথেষ্ট উঁচু নয়।
এদিকে দিবসটি যথাযথভাবে পালনের লক্ষে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ২৯ এপ্রিল' ১৯৯১ স্মৃতি পরিষদসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকালে শোক শোভাযাত্রা, মিলাদ ও নিহত এবং নিখোঁজদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত এবং দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করা।
জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তথ্য মতে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বসে কুতুবদিয়া-দ্বীপসহ উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার জেলায় উপকূল পুরো লন্ডঅন্ড হয়ে পড়ে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা ৩৩ বছরেও সেই ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি। ধারাবাহিকভাবে সৃজিত হয়নি প্যারাবন। উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা প্যারাবন নিধন করে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ ও শুঁটকি মহাল তৈরি করেছেন। এরমধ্যে উপকূলীয় এলাকায় অন্তত পাঁচ হাজার একর প্যারাবন এখন অবৈধ দখলে চলে গেছে। এখন উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় প্যারাবন বলতে আছে শুধু গাছের গোড়ালি, নেই কোনো গাছ। বনবিভাগ প্যারাবন সৃজনের নামে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকা লোপাট করায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল রক্ষায় উপকূলের প্যারাবন সৃজনের কথা থাকলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
সরেজমিন গিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, মহেশখালীর সিরাজ, ইলিয়াছ দু'জনে বয়সের ভাড়ে তেমন চলাচল করতে পারেন না। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে তারা বলেন, সেদিন দুপুর থেকে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের একটু একটু গতির মাত্রা বাড়তে লাগল। সন্ধ্যার দিকে শুরু হয় বাতাসের প্রচন্ড ধাক্কা দমকা হাওয়া। হঠাৎ আক্রমণটা জোরালো হওয়ায় বাহিরে যাওয়ার উপায় ছিল না কারও। সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে বাতাসের মাত্রাও। ঠিক রাত সাড়ে ৮টার দিকে আচমকা দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে বিকট শব্দে তীব্র গতিতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বঙ্গোপসাগরের লোনাপানি। সাগর আর উপকূল একাকার হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে। অন্ধকারে ঘরের ছাদ ও গাছপালাসহ যে যেখানে পায় আশ্রয় নেয় মানুষ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যের সীমাহীন ঝড়োহাওয়ায় বাতাসের তীব্রগতিতে পরাভূত করে ফেলে। মুহূর্তে মানুষ ঘরবাড়ি ও পশুপাখি সব কিছু সাগরের পানিতে ভাসিয়ে লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। আমরা হারিয়েছি পরিবাররের ৮ সদস্য। প্রতি বছর ২৯ এপ্রিল আসলে সেই বিভীষিকাময় কালরাত্রির কথা মনে পড়তেই গা শিহরিত হয়ে উঠে।
খুর স্কুলের সুলতান, আয়েশার কাছে সেই দিনে ২৯ এপ্রিলের কথা জানতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে তারা বলেন, সেদিন দিনভর বৃষ্টি ঘুমোট পরিবেশ। বিকাল হতেই একটু একটু দমকা বাতাস বাড়তে থাকে। এর আগেও বেশ কয়েকবার উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখি কিছুই হয়নি। আমরা সবাই এবার সেই ধরনের মনে করেছিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাতাসের মাত্রা বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে কিছু মানুষ ভয়ে এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি। এদিকে বাতাসের চাপ বাড়তে থাকায় কোথাও বের হতে পারেননি। রাত ৮টার পরে দৃশ্যপট বদলাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড ঝড়োবাতাস বইতে শুরু হলো। মুহূর্তে বাড়িঘরের ঘরের চালা তীব্র বাতাসে উড়ে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। এক সময় সব কিছু ১০ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। পানির সঙ্গে ভেসে যায় আমার মা-বাবা, এক মেয়ে এক ছেলে। তবে ভাগ্যগুণে পাশের একটি বটগাছে আমি আর দুই ছেলে আটকে বেঁচে যাই। ভোরে দেখি চারিদিকে লন্ডভন্ড দৃশ্য, লাশ আর লাশ মানুষ পশু পাখির মৃতদেহ এক সঙ্গে মরা পড়ে রয়েছে। এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি স্বজন হারানোর সেই ক্ষত বেদনাবিধূর জীবন।
মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম আবু হায়দার বলেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা। তখন উপকূলে সুরক্ষিত বেড়িবাঁধ ছিল না। এখন উপকূলের চারপাশে শক্তিশালী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্মাণ করা হয়েছে সাইক্লোন সেন্টার।
কুতুবদিয়া দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলা উদ্দিন আল আজাদ বলেন, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে কক্সবাজার জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কুতুবদিয়া উপজেলা। এই দ্বীপের ব্যাপক সম্পদ হানির পাশাপাশি মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য বেড়িবাঁধও উঁচু করতে হবে। টেকসই বেড়িবাঁধের পাশাপাশি কুতুবদিয়ার চারপাশে প্যারাবন সৃজন করতে হবে।
কক্সবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য আশেকউলস্নাহ রফিক '৯১ এর এদিনে ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের মাগফেরাত কামনা ও শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মহেশখালী-কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় জনগণের জানমাল রক্ষার্থে বেড়িবাঁধের যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। ইতোমধ্যে মহেশখালীকে ডিজিটাল আইল্যাল্ড দ্বীপ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জেলায় উন্নয়নের জোয়ার চলছে।