গ্রামে সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ নেই

প্রকাশ | ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
ওষুধ
দেশের সব সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। এসব হাসপাতালের রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন-আয়ের মানুষ। তবে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সেবা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীকে কিছু ওষুধ দিয়ে বাইরে থেকে বাকিটা কিনে নিতে বলা হয়। এতে নিম্ন-আয়ের অনেক রোগী পূর্ণ ডোজ সেবন করেন না। ফলে সুস্থ হওয়ার জন্য চিকিৎসা নিতে এসেও অনেকে অজান্তে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর একাধিক চিকিৎসক, সিএইচসিপি ও ফার্মাসিস্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিনামূল্যের ওষুধের বাইরে গ্রামাঞ্চলের নিম্ন-আয়ের মানুষজন সম্পূর্ণ ওষুধ কিনে খেতে চান না। আবার প্রান্তিক পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীদের চাহিদার তুলনায় সরকারি ওষুধের বরাদ্দও কম। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ স্বল্পতায় হাসপাতাল থেকে নামমাত্র ফ্রি মেডিসিন দেয়া হয়। পাশাপাশি ডোজ কমপিস্নট করতে বাকিটা কিনে খাওয়ার পরামর্শ দেন। এতে করে সরবরাহকৃত অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধে সাময়িক সুস্থ হলেও কোর্স সম্পূর্ণ না করায় অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে রোগীর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে পরবর্তীতে রোগাক্রান্ত হলে যে ওষুধই সেবন করুক সেগুলো শতভাগ কাজ করে না। যেটা অনেক সময় চিকিৎসক, সিএইচসিপি, ফার্মাসিস্ট এমনকি রোগী নিজেও বুঝতে পারেন না। বিষয়টির সত্যতা জানতে রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপতালে এমডিআর ওয়ার্ডের একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন কুড়িগ্রাম থেকে আসা রোগী আবুল কাশেম (৪০) বলেন, প্রায় সময় তার শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি লেগেই থাকে। চিকিৎসকের কাছে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় প্রত্যেকবার কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনে খেতে বলেন। এক্ষেত্রে কয়েকটা ওষুধ খেয়ে সুস্থ হলে পরে আর ডোজ কমপিস্নট করতে পারি না। দীর্ঘ দিন ধরে এমন করায় এখন চিকিৎসক বলছেন তার শরীরে এমডিআর (মাল্টিড্রাগ রেজিন্ট্যান্স) অর্থাৎ ওষুধ কাজ করছে না। ওয়ার্ডটিতে ভর্তি কাশেমের মতো আরও অনেক রোগীও একই কথা জানান। হাসপাতালে ওষুধের স্বল্পতা সম্পর্কে পাবনা জেলার আটঘরিয়ায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের ফার্মাসিস্ট মো. আব্দুল হালিম যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতি অর্থবছরের শুরুতে (জুন-জুলাই মাসে) হাসপাতাল থেকে ওষুধের চাহিদাপত্র চাওয়া হয়। সেই প্রেক্ষিতে চার কোয়ার্টারে (প্রতি তিনমাস অন্তর) ডিএসআর থেকে ৪৭ আইটেমের মেডিসিন বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে চাহিদা অনুপাতে এ বরাদ্দ খুবই অল্প থাকে। তাছাড়া হাসপাতালে স্টোর-কিপার সরবরাহের ওষুধ অল্প পরিমাণ দেন। ফলে চিকিৎসকরা রোগীদেরকে সম্পূর্ণ কোর্সের ওষুধ লিখলেও মজুদ স্বল্পতার কারণে কিছু ওষুধ দিয়ে বাকিটা কিনে খাওয়ার পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশ রোগীই নিয়ম মানেন না বলে পুনরায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন। ওষুধের এমন অপর্যাপ্ততার ব্যাপারে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ বাংলাদেশে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যেখানে মালদ্বীপের বরাদ্দ ১০ দশমিক ৮, ভিয়েতনামে ৩ দশমিক ৮, নেপালে ২ দশমিক ৩, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক শূন্য, ভারতে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে মোট বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মূলত এসব কারণেই চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ অর্থ সাধারণ মানুষকে পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। যেটা সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্তরা বহন করতে সক্ষম হলেও নিম্ন-আয়ের মানুষরা পারছেন না। আর প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই খরচ জোগাতে না পারায় মাঝপথে চিকিৎসা নেয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে ক্যান্সার ও কিডনি রোগীদের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা হেলথ কমপেস্নক্সের স্টোর-কিপার আব্দুল মালেক যায়যায়দিনকে বলেন, তাদের হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে আড়াইশ থেকে তিনশর মতো রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। সে হিসেবে প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে একটি চাহিদাপত্র দেয়া হয়। তবে মজুদ কম থাকায় চিকিৎসকরা রোগীদের পাঁচ, সাত বা ১৪ দিনের অ্যন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করলেও সরবরাহ কম থাকায় কিনে সেবন বা পরবর্তীতে আসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অনেকে পরবর্তীতে আসেন, কেউ আবার আসেন না। শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ত্রিপলস্নী হাজি আকবর আলী ব্যাপারী কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সুমন মাতবর যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতি তিনমাস অন্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৭টি আইটেমের এক কার্টন করে ওষুধ দেয়া হয়। যেখানে হাজারখানেক ওষুধ থাকে। অথচ ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জনের মতো রোগী আসেন। কিন্তু ওষুধের সরবরাহ কম থাকায় অনেক সময় অর্ধেক ওষুধ দিয়ে বাকিটা কেনার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে ৯০ ভাগ গরিব রোগী বাইরে থেকে ওষুধ কেনেন না বলে সম্পূর্ণ ডোজ পূরণ হয় না। অন্যদিকে পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হালিমা খানম যায়যায়দিনকে বলেন, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ইনডোরের বাইরে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। বছরে চার কোয়ার্টারে ওষুধ দেয়া ছাড়াও জরুরি প্রয়োজনে ওষুধের সরবরাহ আছে। তবে কিডনি, হাইপারটেনশন, কুকুরের কামড়ের্ যাবিস ভ্যাকসিন, গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক চাহিদা অনুপাতে সময়োপযোগী ও গুণগত মানের কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না থাকায় নিরুপায় হতে হয়। তাই উপজেলা পর্যায়ে এসব ওষুধের সরবরাহ দিতে পারলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানসম্মত সেবা নিশ্চিত সম্ভব হতো বলে মনে করেন তিনি। বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম প্রান্তিক পর্যায়ে রোগীদের চাহিদা অনুপাতে ওষুধের সরবরাহ কম বিষয়টি স্বীকার করে যায়যায়দিনকে বলেন, এর প্রধান কারণ স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের সীমাবদ্ধতা। তাই ইচ্ছে থাকলেও সম্পূর্ণ কাভারেজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এটি দ্রম্নত উত্তরণের পরিকল্পনা আছে। আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রী নিজেও তাগাদা দিয়েছেন। বাজেট বাড়লে যে ঘাটতি আছে সেগুলো আর থাকবে না। তখন চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।