ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ

প্রকাশ | ২৫ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ৫১ লাখ ২৭ হাজার টন। এর পুরোটাই আমদানি-নির্ভর। অর্থাৎ বছরে ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়। ফলে প্রতিবছর ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ চলে যায় বিদেশে। এ অবস্থায় দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য সরিষা, তিসি, সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলজাতীয় শস্য আবাদের ক্ষেত্র সম্প্রসারণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায় কৃষি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশে তেলবীজ জাতীয় ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন এবং সূর্যমুখী ইত্যাদি চাষ হয়। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র চার ভাগে তেলবীজের চাষ হয়। দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ২০-২২ গ্রাম করে তেল খায়। কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'আমাদের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী নতুন নতুন তেলবীজের জাত উদ্ভাবন করে ব্যাপক হারে আবাদ করতে হবে। সরিষার উৎপাদন কীভাবে আরও বৃদ্ধি করা যায়, সে বিষয়ে শস্য বিন্যাস অনুযায়ী প্যাকেজ গবেষণা করতে হবে। ভোজ্যতেলের উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে। এ জন্য আমরা কাজ করছি।' তেলবীজ চাষের এলাকা বৃদ্ধি ও উৎপাদন বাড়াতে সরকার কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করবে বলেও জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, 'তেলবীজের উৎপাদন বাড়াতে মাঠপর্যায়ে সরিষার আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এ ছাড়া কৃষকদের উন্নত বীজ সরবরাহ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ এবং কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হবে।' সরিষা বা তৈলবীজ চাষ সম্প্রসারণ ও ভোজ্যতেলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে গত ১৯ মার্চ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কৃষিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সভায় সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি ডিপিপি প্রণয়নে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (গবেষণা) আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ডিপিপি প্রণয়ন এবং সেটা মন্ত্রণালয় দাখিল করতে বলা হয়। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কমলারঞ্জন দাস দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। যুগ্ম সচিব (গবেষণা) বলাই কৃষ্ণ হাজরা এ প্রসঙ্গে বলেন, ভোজ্যতেল জাতীয় শস্যের উৎপাদন বাড়াতে কোথায় কী নির্দেশনা দেয়া যায়, কী করা যায়- সে জন্য কমিটি একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। অতিরিক্ত সচিব বিদেশ থেকে ফিরলে আগামী ২৬ অথবা ২৭ এপ্রিলের দিকে কৃষিমন্ত্রীর কাছে এটি হস্তান্তর করা হতে পারে। পরিকল্পনা আছে, আগামী অর্থবছর থেকে আমরা ডিপিপি অনুমোদনসহ বাস্তবায়নে যাব। প্রস্তাবনায় কী থাকছে- জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব বলেন, 'আমরা মূলত সরিষা, তিসি এবং সূর্যমুখীর চাষ বাড়াতে চাচ্ছি। অনেক স্থানে আমনের পর বোরো চাষ হয়। এর মধ্যবর্তী সময় জমি পতিত থাকে। আমরা আমন চাষের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করতে চাচ্ছি। এতে আমন ও বোরোর মাঝখানে আমরা সরিষা চাষ করতে পারব।' তিনি আরও বলেন, 'আমরা ফাইন্ড আউট করছি, কোথায় সরিষাসহ অন্যান্য তেল জাতীয় শস্য চাষ করতে পারি। আমরা আগামী পাঁচ বছরে ২২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছি।' বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের তথ্যসূত্র উলেস্নখ করে বলাই কৃষ্ণ হাজরা বলেন, '২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৪৬ লাখ ২১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়। যার মোট মূল্য ২৭ হাজার ৩০৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। বর্তমানে উৎপাদিত তেল ফসল থেকে আহরিত তেল এবং রাইস ব্রান অয়েল মিলে বছরে অভ্যন্তরীণ ভোজ্যতেল উৎপাদন প্রায় পাঁচ লাখ টন। কিন্তু আমদানি হয় এর ৯ গুণেরও বেশি।' ডিপিপি প্রণয়ন কমিটিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিনা), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তারা তেলজাতীয় শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয়ে জানাবেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৭-১৮ সালে দেশে মোট চার লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়, মোট ফলন হয় ছয় লাখ পাঁচ হাজার টন। এই সরিষা থেকে ২ দশমিক ৫০ লাখ টন তেল উৎপন্ন হয়। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে ৫০ হাজার হেক্টর, দক্ষিণাঞ্চলে তিন লাখ ২৬ হাজার হেক্টর, মাঝারি নিচু অঞ্চলে দুই লাখ ১০ হাজার হেক্টর এবং হাওর এলাকার জমিতে সাত হাজার হেক্টরসহ মোট পাঁচ লাখ ৯৩ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া অঞ্চলভিত্তিক লাগসই শস্য বিন্যাস প্রবর্তনের মাধ্যমে সরিষার ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে সরিষা উৎপাদনে প্রতিকূল আবহাওয়া ও অন্যান্য ফসলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, তেল আহরণের উপযুক্ত যন্ত্রের অভাব রয়েছে বলেও জানান তিনি। বারির এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে সরিষা ও অন্যান্য ভোজ্যতেল ফসলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বীজ ভালো হলে তা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। বারি ও বিনার কাছ থেকে বীজ বিএডিসির সম্প্রসারণ কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রোপা-আমন, সরিষা ও বোরো- এই তিন ফসলের একটি প্যাকেজ তৈরি করে কৃষকদের দিতে হবে। সরিষার ফলন বৃদ্ধি করতে হলে প্রথমে আমন ধানের জাত নির্বাচন করতে হবে। আমন ধানের এমন জাত রোপণ করতে হবে যা স্বল্পমেয়াদের এবং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কাটা যায়। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সরিষার বীজ বপন করতে হয়। নভেম্বরের ১৫ তারিখের পর সরিষা চাষ করলে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি অল্টারনেরিয়া বস্নাইট রোগ বেড়ে যায়। এতে ফলন হ্রাসসহ বীজে তেলের পরিমাণও কমে যায়। বিনার এক কর্মকর্তা জানান, বিনা-১৪ ধানের জাত মাত্র ১০৫ দিনে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৬ দশমিক ৯ টন উৎপাদন হয়। ফলে শস্য বিন্যাসে বিনা-১৪ ধান অন্তর্ভুক্ত করলে বারি সরিষা-১৮সহ অন্যান্য দীর্ঘজীবনকাল সম্পন্ন সরিষার চাষ সম্ভব। ব্রির এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটি টন ধান থেকে তিন কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপন্ন হয়। এই ধান থেকে ৮ শতাংশ কুড়া পাওয়া যায়। যা থেকে ২০-২২ শতাংশ তেল পাওয়া যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বছরে ছয় লাখ ৫১ হাজার টন রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মাত্র এক লাখ ১৮ হাজার টন রাইস ব্রান অয়েল উৎপন্ন হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ছয়টি কোম্পানির যে সক্ষমতা রয়েছে, তা থেকে এখনই দুই লাখ ২৫ হাজার টন ব্রান রাইস অয়েল উৎপাদন সম্ভব বলেও জানান ব্রির এই কর্মকর্তা। তেল জাতীয় ফসলের ভিত্তিবীজ উৎপাদনের জন্য দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন ভিত্তিবীজ উৎপাদন খামার স্থাপন করা যেতে পারে। চাষিদের তেল জাতীয় ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দিতে ভর্তুকি মূল্যে (৪০-৫০ শতাংশ) মানসম্মত বীজ কৃষি উপকরণ কার্ডের মাধ্যমে চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে বলে মত দেন বিএডিসির এক কর্মকর্তা।