চট্টগ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে

জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীর ৯০ শতাংশের বেশি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি আবাসিকসহ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে নগরীর শতাধিক মার্কেট-বাজার-বস্তি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব মার্কেটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মার্কেটে যেতে হাঁটাচলার পথ যেমন সরু, তেমনি এর ফুটপাত দখল করেও গড়ে উঠেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অগ্নিনির্বাপণের জন্যও আশপাশে কোনো জলাধারও নেই। অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ ও গিঞ্জি মার্কেট-বাজার-বস্তিগুলোয় আগুন লাগলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন রিয়াজুদ্দিন বাজারের রিজওয়ান কমপেস্নক্স মার্কেটে বৃহস্পতিবার আগুন লেগে মারা যান তিনজন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, মার্কেটটিতে অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না। যে কারণে ছোট আগুনেও তিনজন নিহত এবং দুজন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, 'রিয়াজুদ্দিন বাজারে ছোট আগুনে হতাহতের ঘটনা বেশি হয়েছে। আগুন বড় হলে হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতি আরও অনেক বেড়ে যেত। মার্কেটগুলোতে নূ্যনতম অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। এমনকি সড়কগুলো এত ছোট যেগুলো দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করা কষ্টকর। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকায় যেসব মার্কেট, বাজার, বস্তি এবং ভবন আছে সবগুলোতে চিঠি দিয়ে তাগাদা এবং সতর্ক করা হয়। এরপরও ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন সংশ্লিষ্টরা।' এর আগে, ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি চট্টগ্রামের আন্দরকিলস্নায় সমবায় মার্কেটে আগুনে একজন নিহত হন। ওই বছরেরই ১২ জানুয়ারি রিয়াজুদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রিয়াজুদ্দিন বাজারের হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট চৌধুরী পস্নাজায় ও ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে আগুন লাগে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত রিয়াজউদ্দিন, তামাকুমন্ডি এবং হকার্স মার্কেট এলাকায় আছে ছোট বড় ২০০টিরও বেশি মার্কেট। এসব মার্কেটে দোকান আছে ১০-১২ হাজারেরও বেশি। দোকানগুলোর অবস্থা এতটাই ঘিঞ্জি যে, মানুষের হাঁটার জায়গাও অপর্যাপ্ত। বেশির ভাগ দোকানেই নেই কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। জেলা প্রশাসন থেকে কয়েক দফায় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেগুলো মানা হয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নিউমার্কেট কেন্দ্র করে যেসব মার্কেট গড়ে উঠেছে সেগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আশপাশে জলাধার না থাকায় বড় কোনো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিল্ডিং কোড অনুসারে নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ হয়েছে কি না তা দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সংস্থার কোনো নজরদারি না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। নগরপরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, 'চট্টগ্রাম নগরীতে ৯০ শতাংশের বেশি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। রিয়াজুদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, তামাকুমন্ডি লেইনসহ আরও অনেক মার্কেট আছে অনেক বেশি অগ্নিঝুঁকিতে। ছোট আগুনে তিনটি প্রাণ ঝড়েছে। বড় আগুন হলে হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতো। তাই চট্টগ্রামের সবকটি মার্কেট, ভবন, বাজার, বস্তি ফায়ার সেপটির আওতায় আনতে জরিমানা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এজন্য চসিক, সিডিএ, পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে যেসব প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটি নেই; সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ কিংবা সিলগালা করা যেতে পারে।' ফায়ার সার্ভিসের ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক জরিপে বলা হয়, গত বছর ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ৬৭৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১৭ জন, আহত হয়েছেন ৪৫ জন। আগুনে আনুমানিক ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ১৮৫ কোটি ৬৯ লাখ ৫ হাজার টাকার মালামাল। ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় অগ্নিঝুঁকিতে থাকা মার্কেটগুলোর মধ্যে একটি রিয়াজুদ্দিন বাজার। যেখানে একসঙ্গে ১০ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে খাতুনগঞ্জ, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজী সরু মিয়া মার্কেট, নুপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড় পুল বাজার, ইসা মিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইলস্নাতলী বাজার, অধীন চৌধুরী মার্কেট, মহাজন টাওয়ার, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গুলজার মার্কেট, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার, শাহেন শাহ মার্কেট, হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সাপার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলির হাট মার্কেট, ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরোনো জুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপেস্নক্স ও চট্টগ্রাম শপিং কমপেস্নক্স অন্যতম। অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে থাকা বস্তিগুলো হলো- ঝাউতলা, আমবাগান, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, কলসি দীঘির পাড় কলোনি, আকমল আলী কলোনি, লামার বাজার এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন এলাকার রেলওয়ে বস্তি, বার্মা কলোনি, দুই নম্বর গেট ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত রেলওয়ে বস্তি। সরেজমিন দেখা যায়, এলাকার বেশির ভাগ মার্কেট পুরনো হওয়ায় বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। প্রতিটি মার্কেটের ভেতরের গলি এত সরু যে দুজন পাশাপাশি হাঁটা যায় না। অগ্নিকান্ড কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না মার্কেটের ভেতরে। অন্যদিকে অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পানির কোনো উৎস না থাকায় পানি সরবরাহ করাই চ্যালেঞ্জের। জানা যায়, জেলা চট্টগ্রাম প্রশাসকের উদ্যোগে গত বছর বিভিন্ন মার্কেটের প্রতিনিধিদের অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রতিটি দোকানের ফায়ার লাইসেন্সসহ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে, প্রতিটি মার্কেট সমিতিকে অগ্নিনির্বাপণসহ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজস্ব পস্ন্যান থাকতে হবে, মার্কেট সমিতি বিভিন্ন পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা লাগাতে হবে। এসব সিসি ক্যামেরা নজরদারির জন্য ৩-৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে, ডিশ ও ইন্টারনেট লাইন আন্ডারগ্রাউন্ডে নেওয়ার জন্য মার্কেট সমিতি কর্তৃক ডিশ ও ইন্টারনেট মালিকদের অনুরোধ করবেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন মার্কেটসহ, সিটি করপোরেশন, সিডিএ-এর নিয়ন্ত্রণাধীন মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী সমিতি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। এছাড়াও মার্কেটে রিজার্ভ টাংকি, গাড়ি পার্কিং এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রতিটি বাজার ব্যবসায়ী সমিতি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্ব-স্ব বাজারে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আরও বলা হয়, তারা মার্কেট বা বাজার পরিদর্শন করে স্ব-স্ব বাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিকে নিরাপত্তার তথ্য জানাবেন, ফুটপাত অবমুক্ত করার জন্য সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হবে, বৈদু্যতিক লাইনের তার বর্তমান সময় উপযোগী করার জন্য বিদু্যতায়ন বোর্ডকে চিঠি দেওয়া, জহুর হকার্স মার্কেট দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে হওয়ায় ওই দুটি পাহাড় থেকে বড় বড় ট্যাংক বসানোর জন্য মার্কেট প্রতিনিধি নিজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে, মহানগর এলাকায় পুকুরগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে সেগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে চারদিকে হাঁটার ব্যবস্থা করতে হবে। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব সিদ্ধান্তের কোনোটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো আইনগত ব্যবস্থা। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবদুল মালেক বলেন, 'অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া ১১ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন মনিটরিং করছে। যারা সিদ্ধান্ত মানেনি, তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'