রাখাইনে যুদ্ধ বিমান হামলা

টেকনাফ সীমান্তে আতঙ্কিত মানুষের নির্ঘুম রাত

টেকনাফ-সেন্টমার্টিন বিকল্প রুটে নৌ চলাচল ব্যাহত

প্রকাশ | ০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর চলমান সংঘর্ষের মধ্যে আকাশপথে যুদ্ধ বিমান হামলার বিকট শব্দে কাঁপছে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত। রোববার রাতভর ও সোমবার দুপুর পর্যন্ত বিমান হামলা ও গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা গেছে। থেমে থেকে চলা শব্দে এপারের মানুষ আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। এদিকে ৩৩ দিন পর বিকল্প পথে নৌরুট চালুর একদিন পর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ-যান চলাচল ফের ব্যাহত হয়েছে। সোমবার টেকনাফ থেকে একটি নৌযানও সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি। ট্রলার মালিকরা বলছেন, মিয়ানমারে গোলাগুলির ঘটনার জেরে ভয়ে তারা নৌযান ছাড়েননি। স্থানীয়রা জানান, শনিবার ভোর থেকে টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া ও পৌরসভায় তিনটি পয়েন্টে মিয়ানমারের বিমান হামলা, মর্টারশেল-ভারী গোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন সীমান্তের মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি শব্দ শুনতে পেয়েছেন শাহপরীর দ্বীপের মানুষ। শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাটের দোকানদার আবু তালেব স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, 'শনিবার দুপুরের দিকে শাহপরীর দ্বীপে ওপারের মিয়ানমার সীমান্তে আকাশপথে দুটি যুদ্ধ বিমানের হামলায় বিকট শব্দ শোনা গেছে ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখা গেছে। নাফ নদীর তীরে প্রতিদিন গুলির শব্দে সীমান্তের বসবাসকারী মানুষের আতঙ্কের দিন পার করতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিকট শব্দে আমাদের ঘরবাড়ি কেঁপে উঠছে।' শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়ার মৎস্য সমিতির সভাপতি আব্দুল গণি বলেন, 'মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা নাফ নদীতে আমার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এ নদী আমাদের জীবনসঙ্গী। নাফের ওপারে গত ছয়-সাত মাস ধরে যুদ্ধ চলছে। যার ফলে আমাদের জীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছে। এখন গোলার বিকট শব্দ আমাদের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় যুদ্ধ বিমানের হামলাও দেখা যাচ্ছে। আজকেও দুটি যুদ্ধ বিমানের হামলা চোখে পড়েছে।' রাখাইনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। রাজ্যটির অনেক এলাকা জান্তার হাতছাড়া হলেও তারা বিমান থেকে হামলা অব্যাহত রেখেছে। এদিকে রোববার নাফনদে কাঁকড়া শিকারে যাওয়া এক রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি মাইন বিস্ফোরণ অথবা মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও দুই রোহিঙ্গা আহত হন। এ পরিস্থিতিতে টেকনাফের নাফ নদীতে জেলেদের মাছ শিকারে না যেতে মাইকিং ও সতর্ক করেছে নৌ-পুলিশ। টেকনাফের নৌ-পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, 'নাফ নদীতে কাঁকড়া শিকারে যাওয়া এক রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও দুই রোহিঙ্গাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তারা মাইন বিস্ফোরণ নাকি মর্টার শেলের আঘাতে হতাহত হয়েছেন, তা বলা মুশকিল। তবে কীভাবে মৃতু্য হয়েছে, তা চিকিৎসকরা স্পষ্ট বলতে পারবেন।' তিনি বলেন, 'সীমান্তে রাতভর গোলার বিকট শব্দ শোনা যায়। ফলে এখন থেকে জেলেরা যাতে নাফ নদীতে না যান, সেজন্য মাইকিংয়ের পাশাপাশি সতর্ক করা হয়েছে। এ ছাড়া নাফ নদীতে রোহিঙ্গাকে মৃত উদ্ধারের বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি চলছে।' সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধের কারণে সীমান্তের বাসিন্দাদের আতঙ্কে দিন কাটছে। রোববার রাতে গোলার বিকট শব্দে তাদের বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। এমন শব্দ তারা আগে কখনো শোনেননি। টেকনাফ সীমান্ত এলাকা জালিয়া পাড়ার বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, 'ওপারে টানা কয়েক মাসে ধরে চলা যুদ্ধে এপারে মানুষের আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। রোববার রাতে যুদ্ধ বিমান ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আমাদের বাড়িঘরের দরজা-জানালা কেঁপে ওঠে। ভয়ে আমরা পরিবারের লোকজন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। এমন বিকট শব্দ আগে শুনিনি। সারারাত আমরা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।' টেকনাফ-২ বিজিবির ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, 'আজকেও (সোমবার) মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। নতুন করে যাতে কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। সীমান্তে বসবাসকারী লোকজনকে জরুরি কাজ ছাড়া ঘোরাঘুরি না করতে বলা হয়েছে।' স্থানীয়রা জানায়, রোববার গভীর থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং, হ্নীলা, পৌরসভা, সদর, সাবরাং ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের সীমান্তে ভারী গোলার শব্দ শোনা গেছে। হ্নীলার বাসিন্দা মো. সাইফুল বলেন, 'আমার এলাকায় রাতে অনেক ভারী গোলার শব্দ শোনা গেছে। সকাল থেকে শব্দ কমেছে। তবে আতঙ্ক কমেনি।' সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধে রাখাইনের মংডু শহরের উপকণ্ঠ ছাড়াও অনেক স্থানে হেলিকপ্টার হামলা হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ৪ হাজার লোক বাড়িঘর ছেড়ে সীমান্তের গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছেন। টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বলেন, 'রাতে সীমান্তে ভারী গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। সকালে কিছুটা শব্দ কমেছে। আমরা বিজিবির সহায়তায় সীমান্তের লোকজনকে জরুরি কাজ ছাড়া অযথা সীমান্তে ঘোরাঘুরি না করতে নিষেধ করেছি।' টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'এখনো মিয়ানমার সীমান্তে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমান্তে আমরা খোঁজখবর রাখছি।' এদিকে সোমবার টেকনাফ-সেন্টমার্টিন বিকল্প নৌরুটে ট্রলার ছাড়েননি মালিকরা। ৩৩ দিন পর বিকল্প রুটে একদিন চালুর পর নৌ-যান চলাচল আবারও ব্যাহত হয়েছে। এই রুটের ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, 'টেকনাফ সংলগ্ন মিয়ানমারে সংঘর্ষের কারণে টেকনাফের গোলারচর বিকল্প রুটের কোনো ট্রলার শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি। সেন্টমার্টিন থেকে একটি ট্রলার দুপুরে নিরাপদে টেকনাফে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আজ মঙ্গলবার এ রুটে ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল করবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, 'গোলারচর হয়ে এই রুটটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বর্তমানে নাইক্ষ্যংদিয়া হয়ে আগের রুটটি ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় জানা নেই।' গত ৬ জুন থেকে নাফ নদীর মোহনার নাইক্ষ্যংদিয়া পয়েন্টে বাংলাদেশি ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনায় কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও টেকনাফ উপজেলার মধ্যে নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ রোববার টেকনাফের কায়ুকখালী খাল থেকে তিনটি সার্ভিস ট্রলার শতাধিক যাত্রী, কয়েক বস্তা চাল-ডাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে সেন্টমার্টিন যায়। একইভাবে সেন্টমার্টিন থেকে তিনটি সার্ভিস ট্রলার ও তিনটি স্পিডবোটে প্রায় ২০০ যাত্রী নিয়ে টেকনাফে এসেছে বলে জানান সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান। ১৪ জুন ঈদুল আজহার আগে কক্সবাজার থেকে একটি পর্যটকবাহী জাহাজ খাদ্য ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও যাত্রী পরিবহণ করে সেন্টমার্টিনে গিয়েছিল। পরের দিন জাহাজটি ফিরে আসে। অন্য কিছু ট্রলারও পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের জন্য বিকল্প রুটে নিয়েছে। তবে ৬ জুন থেকে দ্বীপ ও মূল ভূখন্ড টেকনাফের মধ্যে নিয়মিত চলাচল বন্ধ রয়েছে।