সিএনজিচালিত অটোরিকশা

মিটারে চলে না, তবু ভাড়া বৃদ্ধির চেষ্টা

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১৮:১২

যাযাদি রিপোর্ট
সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকদের স্বার্থে ভাড়া ও দৈনিক জমা বৃদ্ধি করাই যেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। চালুর পর অন্তত পাঁচবার অটোরিকশার ভাড়া ও দৈনিক জমা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু একবারও বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে আরেক দফা অটোরিকশার ভাড়া ও দৈনিক জমা বৃদ্ধির তৎপরতা শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে বৈঠক করে বিআরটিএর এ সংক্রান্ত কমিটি। কমিটিতে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের বাইরে অটোরিকশার মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাই বেশি। ওই সময় একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। উপকমিটি গত ৩০ মে বৈঠক করে দৈনিক জমা ৩০০ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা করার প্রস্তাব তৈরি করে। আর অটোরিকশার সর্বনিম্ন ভাড়া দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। উপকমিটি প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া প্রস্তাব করেছে ২৫ টাকা, যা এখন ১৪ টাকা; অর্থাৎ এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে ভাড়া বাড়বে ৭৯ শতাংশ। আর প্রতি এক মিনিট যাত্রাবিরতির জন্য মাশুল দুই টাকা থেকে বাড়িয়ে চার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিআরটিএ সূত্র জানায়, প্রস্তাবটি এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে দু-একটি বৈঠক করে প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। এরপর তা সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া সর্বশেষ নির্ধারিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিগত ৯ বছরে দেশে শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হয়েছে। এতে অটোরিকশার চাহিদা কিছুটা কমে গেছে। এ জন্য ভাড়া ও জমা বৃদ্ধির বিষয়ে দীর্ঘদিন উচ্চবাচ্য ছিল না। গত বছর থেকে অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানোর চাপ শুরু হয়। অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিষয়টি এগোয়নি। ভাড়া বৃদ্ধি-সংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য এবং ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা ও মিশুক চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অটোরিকশার মালিকেরা শ্রমিকের পকেট কেটে দৈনিক জমা বেশি নেন। এ কারণে চালকেরা যাত্রীদের পকেট কাটেন। এটা বন্ধ করতে হলে পুলিশ, বিআরটিএ ও অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুবা ভাড়া ও জমা বাড়িয়ে লাভ নেই। নির্ধারিত ভাড়া 'কেউ মানেন না' ২০০৩ সালের দিকে রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে বেবিট্যাক্সি তুলে দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালু করে তৎকালীন চার-দলীয় জোট সরকার। মিটারে নির্ধারিত ভাড়া এবং যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে চলাচল করতে বাধ্য থাকবে- এই ছিল মূল শর্ত। কিন্তু নগরবাসী বলছেন, কখনোই শর্তগুলো মানা হয়নি। ভাড়া নির্ধারিত হয়েছে চালকের ইচ্ছেমতো। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা অনীহা দেখান। সিএনজিচালিত অটোরিকশার নীতিমালা অনুসারে মালিকেরা অটোরিকশা কিনে চালকদের চালাতে দেবেন। বিনিময়ে সরকার নির্ধারিত হারে দৈনিক জমা পাবেন তারা। আর চালকেরা মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করবেন। বর্তমানে অটোরিকশার মালিকের জন্য দৈনিক জমা নির্ধারিত আছে ৯০০ টাকা। তবে চালকেরা বলছেন, মালিকেরা দিনে দুই বেলায় চালকের কাছে অটোরিকশা ভাড়া দিয়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন। অটোরিকশার বর্তমান সর্বনিম্ন (প্রথম দুই কিলোমিটার) ভাড়া ৪০ টাকা; অর্থাৎ একজন যাত্রী চাইলে ৪০ টাকায় অটোরিকশা ভাড়া করার সুযোগ পাবেন। যাত্রীদের অভিযোগ ১৫০ টাকার নিচে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াত করা যায় না। দুই কিলোমিটারের পরের প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা নির্ধারিত থাকলেও তা কেউ মানেন না। নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর বিআরটিএ কিছুদিন অভিযান চালায়। এরপর আগের মতোই বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়। রাজধানীর ফার্মগেট থেকে সচিবালয়ের দূরত্ব ৪ কিলোমিটারের কিছু বেশি। মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় এই পথে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে (যানজটসহ) ৭০-৮০ টাকার বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু এখন অটোরিকশায় ১৫০-২০০ টাকার নিচে ওঠাই যায় না। কিছুটা দূরের গন্তব্যে ৩৫০-৪০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০১৬ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। এতে দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ অটোরিকশা মিটারে চলে না। ৮৭ শতাংশ যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যায় না। যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ভাড়া ও জমা বৃদ্ধির পর তারা এই সমীক্ষা চালিয়েছিল। এখন কেউ মিটারে চলাচল করেন না। সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উলস্নাহ নূরী বলেন, অটোরিকশা যাত্রীদের কোনো সেবা দিতে পারছে না। এই যানের বিষয়ে কঠোর চিন্তা করা উচিত। ভাড়া ও জমা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তিনি দেখবেন বলে জানান। দাম ৬ লাখ, কেনাবেচা ২০ লাখে বাজারে ভারতের বাজাজ কোম্পানির তৈরি একটি অটোরিকশার দাম এখন সাড়ে পাঁচ লাখ থেকে পৌনে ছয় লাখ টাকা। অথচ বিআরটিএর নিবন্ধন পাওয়া প্রতিটি অটোরিকশা এখন হাতবদল হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায়। মালিক ও চালক সূত্র বলছে, একটি অটোরিকশা থেকে দিনে দেড় হাজার টাকা ও মাসে ৪৫ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ আছে। এ কারণেই নিবন্ধিত অটোরিকশার দাম এত বেশি। বিআরটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সীমিত অটোরিকশা চলাচল করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। এ কারণেই দাম এত বেশি এবং চড়া হারে ভাড়া ও দৈনিক জমা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ২০০৩ সালের আগে শুধু ঢাকায় ৬০ হাজারের মতো বেবিট্যাক্সি চলাচল করত। এগুলো তুলে দিয়ে ১২ হাজার সিএনজি অটোরিকশা নামানো হয়। তখন অটোরিকশার অনুমতিপত্র বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে ২৭ হাজারের মতো সিএনজিচালিত অটোরিকশা রয়েছে। ঢাকায় প্রাইভেট গাড়ি, মোটর সাইকেল ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা অবাধে বাড়ছে। কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। শুধু অটোরিকশার ক্ষেত্রে এই সীমা রয়েছে। আর অটোরিকশার মেয়াদ (১৫ বছর) শেষ হয়ে গেলে পুরনো মালিকেরাই নতুন অটোরিকশা নামানোর সুযোগ পান। এই সুযোগে নিবন্ধনসহ অটোরিকশার হাতবদল করে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আয় করতে পারেন মালিকেরা। বিআরটিএ ও মালিক সূত্র জানায়, অটোরিকশার মালিকানায় এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও জড়িত। ফলে এ খাতে নৈরাজ্য বন্ধে বিআরটিএ শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, একটি পুরনো বাসের দাম ১০-১২ লাখ টাকা। অথচ অটোরিকশা বিক্রি হয় ২৫ লাখে। অটোরিকশা এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁসে পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বিআরটিএর ব্যর্থতায়। তিনি বলেন, বিআরটিএ যাত্রীদের সুবিধা না দেখে নৈরাজ্যে উৎসাহ দেয়।