হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আহতরা ভালো নেই। গত ৯ দিন ধরে তলপেটে বুলেট নিয়ে ছটফট করছে নরসিংদী পাঁচদোনার অলিউলস্নাহ। হাপাতালে কয়েক দফা অপারেশনেও পেটের বুলেট বের করতে পারেনি চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডেকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন তিনি। এই শয্যার চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন অলিউলস্নাহর মা বাবা, মামা-মামি, নানি ও চাচা।
নরসিংদী পাঁচদোনা এলাকার রিকশাচালক কামাল হোসেনের ছোট ছেলে ১৫ বছরের অলিউলস্নাহ। গত ২০ জুলাই শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে নরসিংদী পাঁচদোনা এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিপির সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন। অলিউলস্নাহ স্থানীয় একটি স্কুলে পাড়াশোনার পাশাপাশি বাড়ির পাশের একটি ওয়েন্ডিং কারখানায় কাজ শিখতেন।
সোমবার সরেজমিন ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে অলিউলস্নাহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
অলি উলস্নাহর বাবা রিকশাচালক কামাল হোসেল বলেন, 'ডান পাশের নাভির নিচে গুলি লেগেছিল। প্রচুর রক্ত ঝরেছে। চিকিৎসকরা আপারেশন করে গুলি বের করতে পারেনি। তাদের পরামর্শ গুলি গুলির জায়গায় থাকবে, চিকিৎসাও চলবে। এখন গুলি বের করা সম্ভব না। প্রতিদিন এক ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। এখন শরীরের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। শরীর শুকিয়ে হাড় বের হয়ে পড়ছে। ছেলের জীবন মুতু্যর সন্ধিক্ষণে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।'
হাসপাতালে চিকিৎসক ও সিনিয়র স্টাফ নার্সরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আহতরা ভালো নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে যেসব গুলিবিদ্ধ রোগী ভর্তি আছেন। তাদের অনেকেই জীবনমৃতু্যর সন্ধিক্ষণে। যাদের মাথায় গুলি লেগেছে তাদের জরুরি বিভাগের ১০০ নম্বরে এবং পেটে, বুকে, পায়ে গুলিবিদ্ধ রোগীদের ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্যা থাকলে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন বিভাগে রেফার্ড করা হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে বর্তমানে ২০০-২৫০ জন গুলিবিদ্ধ রোগীর চিকিৎসা চলছে।
১০১ নম্বর ওয়াডের্র ১৯ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন আছেন রাজধানীর শনির আখড়ার ১৪ বছর বয়সের সুমন মিয়া। সুমন অটো চালিয়ে বিধবা মায়ের সংসারের হাল ধরেছিল। সুমনের মা শেফালি বেগম বলেন, '২০ জুলাই (শনিবার) পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির সময় আমার ছেলের গুলি লাগে, গুলি তলপেট লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। গুলি খেয়ে কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিল। পরে এলাকার লোকজন হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আমরা রাতে জানতে পারি। ছেলে হাত পা নড়াচড়া করতে পারছিল না।'
শেফালি বেগম বলেন, 'ছেলের উপার্জনে পাঁচজনের সংসার চলত। এখন হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। প্রধানমন্ত্রীর ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। ধারদেনা ও কিছু ওষুধ কিনতে টাকা শেষ। এত অল্প টাকা দিয়ে কতদিন চলে। প্রতিদিন এক-দুই ব্যাগ রক্ত লাগে। ছেলের যে অবস্থা মনে হয়, বাঁচানো যাবে না।'
১৭ নম্বর শয্যায় কাতরাচ্ছিলেন কুমিলস্নার ইমন মিয়া। ইমনের ছোট ভাই জানান, 'ভাই যাত্রবাড়ীর একটি দোকানে কাজ করতেন। দোকান খুলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হলে ২১ তারিখ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন চিকিৎসা চলছে। একদিকে রক্ত, অন্যদিকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।'
১০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন সাইনবোর্ড এলাকায় গার্মেন্ট কারখানায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হওয়া আকাশ। তার বাবা শেখ বাদশা বলেন, '১৯ তারিখ রাতে আকাশকে হাসপাতালে আনা হয়। তলপেটের ডানপাশে গুলি আটকে ছিল। হাসপাতালে চিকিৎসকরা সেটা বের করেছে। এখন পর্যন্ত অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। রক্ত দিতে হচ্ছে।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সার্জন ডা. মো. আলউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আহত রোগীর চিকিৎসায় আমাদের চেষ্টার কোনো ক্রটি নেই। যেসব রোগী সিরিয়াস ছিল, সেসব রোগীকে আগে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যে রোগীকে যে বিভাগে রেফার্ড করা প্রয়োজন আমরা সেখানে রেফার্ড করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে।'
ঢাকার ৩১ হাসপাতালের
তথ্য : আহত ৬৭০৩ জন
এদিকে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীতে সংঘর্ষ ও সংঘাতে আহত ছয় হাজার ৭০৩ জনের কথা জানা গেছে। তারা ৩১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এসব রোগী ১৬-২২ জুলাইয়ের মধ্যে হাসপাতালে এসেছেন।
ইটপাটকেল ও লাঠি বা রডের আঘাতে আহত হয়ে কিছু মানুষ হাসপাতালে এসেছিলেন। তবে বেশি মানুষ হাসপাতালে এসেছেন ছররা গুলি, রাবার বুলেট বা বুলেটবিদ্ধ হয়ে। আবার কেউ কেউ এসেছেন কাঁদানে গ্যাসের কারণে অসুস্থ হয়ে। সাউন্ড গ্রেনেডেও মানুষ আহত হয়েছেন।
রাজধানীতে সংঘর্ষ-সংঘাত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বেশি সংঘর্ষ হয়েছে উত্তরা, বাড্ডা-রামপুরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর-বছিলা এবং ধানমন্ডি এলাকায়। আহত ব্যক্তিরা এসব এলাকার কাছের হাসপাতালে প্রথমে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়।
২২টি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন দুই হাজার ৫৯৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত মানুষ এসেছিলেন রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে।
২৩-২৭ জুলাই রাজধানীর মোট ৩৮টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে মোট কত মানুষ আহত হয়েছেন, এর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতাল ৯টি, বাকি ২৯টি বেসরকারি হাসপাতাল। তবে সাতটি বেসরকারি হাসপাতাল কোনো তথ্য দেয়নি।
রোগীদের একটি অংশ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। একটু গুরুতর রোগীকে এক বা দুই দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এখনো অনেক রোগী হাসপাতালে আছেন। আহতদের কেউ কেউ হাসপাতালেও মারা গেছেন।
তবে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া সব আহত মানুষের তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষে ঠিকমতো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতাল চিকিৎসা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে ছেড়ে দিয়েছে। রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স লিখে রাখার সময় ও সুযোগ ছিল না।
সংঘর্ষে আহত সবচেয়ে বেশি মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বা পঙ্গু হাসপাতালে। ২৩ জুলাই হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, এই হাসপাতালে ১৭-২২ জুলাই পর্যন্ত এক হাজার ২৬৯ জন চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন ২৩১ জন। হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় ৫৩৭ জনকে। অর্থাৎ এই হাসপাতালে আসা ৪২ শতাংশ রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসার দরকার ছিল।
যেকোনো বড় সংঘর্ষ বা দুর্যোগের ঘটনায় হতাহত মানুষ বেশি আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ২৩ জুলাই বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, ওই প্রতিষ্ঠানে মোট এক হাজার ৭১ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে অনেকের ধারণা, এই প্রতিষ্ঠানে আরও অনেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের সবার তথ্য কর্তৃপক্ষের রাখা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মেডিকেল ও পঙ্গু হাসপাতাল ছাড়া আরও ৯টি হাসপাতালে চার হাজার ১১০ জন চিকিৎসা নিতে এসেছেন।
সাতটি বেসরকারি হাসপাতালের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এসব হাসপাতালের আশপাশের মানুষ বলেছেন, আহত মানুষ এসব হাসপাতালে এসেছিলেন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো তথ্য যেন সাংবাদিক বা অন্য কাউকে না দেওয়া হয়, এর জন্য চাপ থাকার কথা বলেছেন কেউ কেউ।
২২টি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন দুই হাজার ৫৯৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত মানুষ এসেছিলেন রামপুরার ফরাজী হাসপাতালে। হাসপাতালের উপ-মহাপরিচালক রুবেল হোসেন বলেন, ৯৫০ জন আহত রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। এর মধ্যে ১৮ জুলাই এসেছিলেন ৩০০ জন, ১৯ জুলাই ৬০০ জন এবং ২০ জুলাই ৫০ জন। তিনি বলেন, এসব রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।