এনবিআরে এখনো থামেনি মুনিম অনুসারীদের দুর্নীতি
এনএসডবিস্নউ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ
প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বিশেষ প্রতিনিধি
অবসরের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিমকে চুক্তিতে রেখেছিল শেখ হাসিনার সরকার। ক্ষমতার পালাবদলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দাবির মুখে আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে চাকরি থেকে বাদ দিয়েছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার। সাবেক এ চেয়ারম্যান অবসরে গেলেও তার কাছের ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের দুর্নীতি থেমে নেই। বিশেষ করে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সরলীকরণ, বাণিজ্য ব্যয় কমানো এবং অটোমেশনের মাধ্যমে বাণিজ্য কার্যক্রম গতি বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোজ (এনএসডবিস্নউ) প্রকল্পে আবারো দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের সময় সব ক্ষেত্রে সংস্কার, দুর্নীতি রোধ ও বৈষম্য বিরোধের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানের পৃষ্ঠপোষক দুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন এবং তারা আরও বেশি উজ্জীবিত। প্রকৃত রাজস্ব আহরণ এবং দুর্নীতি রোধে প্রকৃত দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানকে দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্সের দিকে আরও বেশি নজরদারি বাড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।
সূত্র জানায়, সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম আমলে এনএসডবিস্নউ প্রকল্পের সফটওয়্যার কেনা নিয়ে নয়ছয় হয়। রহমাতুল মুনিমের নেতৃত্বে প্রকল্পে দায়িত্বরত অবস্থায় যেসব কর্মকর্তা পেছন থেকে দুর্নীতি ও লুটপাটের কলকাঠি নেড়েছেন তারাই এখনো বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সময়ে আবারো ২১২ কোটি টাকার বিশেষ কোনো কোম্পানিকে হার্ডওয়্যার কেনার টেন্ডার দিয়ে সহযোগিতা করছেন। এজন্য নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনবিআর'র সাবেক এ চেয়ারম্যান আবু হেনার নেতৃত্বে এ প্রকল্পের
সঙ্গে জড়িত অনেক দায়িত্বরত কর্মকর্তারা পরামর্শক হিসেবে বিশেষ ওই কোম্পানির জন্য কাজ করছে। এসব কর্মকর্তারা কোম্পানিটির সফলতার পরিকল্পনা হিসেবে টেন্ডারের প্রযুক্তিগত স্পেসিফিকেশন এমনভাবে প্রস্তুত করেছে যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং তাদের নির্ধারিত কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ সম্পূর্ণ কমপস্নায়েন্স পূর্ণ করে জমা দিতে পারবে না।
সূত্রে জানা গেছে, কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান, সদস্য (অব.) জাকিয়া সুলতানা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট একজন প্রভাবশালী সদস্য এনএসডবিস্নউ প্রকল্প হতে আর্থিক দুর্নীতি ও লুটপাটের জন্য এনএসডবিস্নউ'র ভেন্ডর (বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠান) পক্ষে আইসিটি অনুবিভাগ হতে অবসরপ্রাপ্ত সিস্টেম ম্যানেজার এ কে এম জাহিদ হোসেনকে এবং মো. ফজলুর রহমানকে সম্পৃক্ত করেন। এ ছাড়া অভিযোগ পাওয়া গেছে, দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সহযোগিতা না করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কাজী মুহাম্মদ জিয়াউল হককে বাদ দিয়ে প্রথমে এ কে এম জাহিদ হোসেনকে, পরবর্তীতে মো. ফজলুর রহমানকে এবং সর্বশেষ মো. জাহিদুর রহমানকে সিস্টেম ম্যানেজার পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। জাহিদুর রহমানকে ২০২৪ সালে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড ক্রয়কার্যে দুর্নীতিতে তার দক্ষতা এবং লুটপাটে সহযোগিতার জন্য সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা পুরস্কার স্বরূপ ২০২৪ সালে ২৮ জানুয়ারি সিস্টেম এনালিস্ট হতে সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট পদে এবং একই বছর মার্চ মাসের ২০ তারিখে সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট হতে সিস্টেম ম্যানেজার পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়, অর্থাৎ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে পরপর ২ মাসের মধ্যে তাকে ২টি পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, 'প্রকল্পের কোনো দুর্নীতির সঙ্গে আমি জড়িত নই। সফটওয়্যার কেনার কোনো কমিটিতে আমার নাম ছিল না। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।'
সূত্র আরও জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাস্টমস সংশ্লিষ্ট অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেসের ডাটাবেইজ সফটওয়্যার লাইসেন্স ৩ বছরের জন্য ক্রয় করা হলেও তা প্রকৃতপক্ষে ১ বছরের জন্য লাইসেন্স অ্যাক্টিভেট করা হয়। যার মূল্য বেশ কয়েক কোটি টাকা। শুরুতেই ৩ বছরের জন্য লাইসেন্সের বিল বাবদ সংশ্লিষ্ট ভেন্ডরকে অর্থ পরিশোধ করা হয়। বাকি ২ বছরের লাইসেন্সের অর্থ পারস্পরিক যোগসাজশে ভেন্ডরের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, একটি সভায় কাস্টমস সিস্টেমের জন্য নিম্নমানের পণ্য ক্রয় এবং সিস্টেমের নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ দুর্নীতির বিষয়টি সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যানের নজরে আনা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানসহ একাধিক উচ্চতর পদে পদোন্নতি প্রদান করেন।
ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সময় বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাবাদী এবং কার্যত স্বৈরাচারী কর্মকর্তারা বছরের পর বছর আমাদের চরমমাত্রায় ভীতি প্রদর্শন করে নিয়োগে অনিয়ম, বদলি বাণিজ্য, পদায়ন বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্যসহ অবসরকালীন সুবিধার মতো ক্ষেত্রগুলোতে স্বেচ্ছাচারিত্বের এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
কর্মচারীরা বলছেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা বৈষম্যবিরোধী কর্মচারীরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা, পরিশ্রম এবং সাধনা দিয়ে রাষ্ট্রের মূল কোষাগার তথা রাজস্ব ভান্ডারে রাজস্ব আদায়ে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রাজস্ব বোর্ডের প্রাণস্পন্দন এবং শক্তিশালী করতে দুর্নীতিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ বিষয়ে এনবিআর আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের ফোনে যোগাযোগ হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।