নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে নানা প্রজাতির মাছ কড়া রোদে শুকানো হচ্ছে -যাযাদি
ভোজনরসিক বাঙালির কাছে ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু খাবার শুঁটকি। এর মধ্যে সামুদ্রিক শুঁটকি খুবই মজাদার। শুঁটকি মাছ অনেক দিন ঘরে রেখে খাওয়া যায় আর এতে রয়েছে নানা পুষ্টি উপাদান। প্রতি বছর শীতের শুরু মানেই কক্সবাজারে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম শুরু। আর মৌসুমের শুরুতে উপকূলে ইতোমধ্যেই শুঁটকি উৎপাদনের ধুম লেগেছে।
নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে সকালে গিয়ে দেখা গেল উপকূলীয় জেলে পলস্নীর মানুষগুলোর ব্যস্ততা। মহালের চারদিকের বাতাসে বইছে কাঁচা ও শুঁটকি মাছের গন্ধ। এখানে যারা কাজ করছেন তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এদের মধ্যে অনেকে শুকানোর জন্য কাঁচা মাছ তপ্ত বালির ওপর বিছিয়ে দিচ্ছেন, কেউ বস্তাবন্দি করছেন, কেউ আবার মাঁচায় রাখা মাছ নেড়ে দিচ্ছেন শুকানোর জন্য।
শুঁটকি মহালে সাগরের ৩০ প্রজাতির মাছ ছুরি, লইট্যা, ফাইস্যা, সুরমা, চাপিলা, চিংড়ি, বাটা, লায়োক্কা, মাইট্যা, রুপচাঁদা, কোরাল, গুইজ্যা, চাপা, ইচা শুঁটকি, লাল ইচা, মইল্যা, পোপা, মিশালী, কেচকি, লবণ ইলিশ, ধইঞ্চা, কালোচান্দাসহ আরও বেশ কিছু মাছ শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইলিশ মাছ দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ কড়া রোদে শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো নিরলস প্রচেষ্টায় মাছ শুকানো হয় বলে কক্সবাজারের সুস্বাদু শুঁটকি শুধু দেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সমাদৃত। আগামী মে পর্যন্ত টানা চলবে শুঁটকি উৎপাদন।
শুঁটকি মহালের শ্রমিক দিলারা বেগম (২৫) স্বামীর একার উপার্জনে সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হয় বলে তিনিও শুঁটকি মহালে কাজ করেন। তিনি বলেন, 'কড়া রোদে ভীষণ কষ্ট হলেও সন্তানদের ভালো রাখার জন্য কাজ করছি। কাজ অনুযায়ী কোনো দিন ৬শ' কোনো দিন ৭শ' বা তারও বেশি মজুরি পাই।'
তিন সন্তানের জননী মরিয়ম আকতারকে (২৪) ছেড়ে তার স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেছেন। ছেলেমেয়েরও কোনো খবর তিনি নেন না। অভাবের সংসার তাই তিনি দুই মেয়ে নিয়ে শুঁটকি মহালে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, 'সন্তানদের পড়ালেখা করানোর খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অভাবের কারণে পড়াশোনা করাতে পারি নাই। এখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো আছি। শুঁটকি মহালে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। আমি অনেক নারীকেও এই মহালে চাকরি নিয়ে দিয়েছি। বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কাজ শেষে টাকা পাই।'
এই মহালে কাজ করা সুলতান আহম্মদ (১৪) কাঁচা মাছ কাটাকাটি ও পরিষ্কার করতে খুবই পারদর্শী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই কাজে জড়িত। তার বাবা-মা দুজনে অসুস্থতার জন্য কোনো কাজ করতে পারেন না।
তিনি বলেন, 'আমি ও আমার ছোট দুই ভাই এখানে কাজ করি। মোটামুটি সংসার চলছে। এখানে একটি এনজিও আমার বাবা-মায়ের চিকিৎসা করিয়েছেন। এই শুঁটকি মহালে অনেক শিশু কাজ করে।'
নাজিরারটেকের বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উলস্নাহ চৌধুরী বলেন, এখানে প্রায় একশ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকি পলস্নী। প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক-ব্যবসায়ী এখানে কাজ করেন। শুঁটকি মহালে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক আড়ত রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৩শ' টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতিবছর ৯ মাস পর্যন্ত এই মহালে শুঁটকি উৎপাদন করে বাজারজাত করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে চলতি মৌসুমে ৮শ' কোটি টাকা শুঁটকি রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিদেশে রপ্তানিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে পর্যটন মৌসুমকে ঘিরেও কক্সবাজারে জমজমাট হয়ে উঠেছে শুঁটকির ব্যবসা। শহরের শুঁটকির দোকানগুলো সেজেছে বিশেষ সাজে। এসব দোকানে প্রায় সারা দিনই পর্যটক ক্রেতার ভিড় থাকে। স্থানীয়রা কেনাকাটা করলেও পর্যটকেরাই শুঁটকি বাজারের মূল ক্রেতা। পর্যটকদের নজর কাড়তে দোকানে চকচকে পলিথিনে মুড়িয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন জাতের শুঁটকি। এতে করে শুঁটকির মান ভালো থাকে এবং সহজে নষ্ট হয় না। তাছাড়া পর্যটকরা শুঁটকি কেনার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করেও কুরিয়ারে পাঠানোর জন্য অর্ডার করেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখন দু'ভাবে মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রথমটি প্রচলিত পদ্ধতি আর অন্যটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। প্রচলিত পদ্ধতিতে মহালগুলোতে কাঁচা মাছ কড়া রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিএফআরআই (বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট) উদ্ভাবিত 'ফিস ড্রায়ার' ব্যবহার করে শুকানো হয়। কক্সবাজারে এখন উৎপাদিত হচ্ছে এই সুস্বাদু অর্গানিক শুঁটকি। তবে এই শুঁটকির দাম একটু বেশি।
শুটকি রপ্তানিকারকরা জানান, জেলায় ২০টির বেশি রপ্তানিমুখী শুঁটকির কারখানা আছে। এখান থেকে শুঁটকির একটি বড় অংশ যায় হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে।
শহরের বড়বাজার শুঁটকি আড়তের ব্যবসায়ী আবদুস সোবহান বলেন, 'কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা কুতুবদিয়া, মহেশখালী সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, বড়ঘোপ, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার নাজিরারটেক, ফদনারডেইল, ফিশারিঘাট, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদন্ডিসহ আরও বেশ কিছু এলাকায় এখন শুঁটকি উৎপাদনে সরগরম।'
তিনি জানান, 'শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লায়োক্কা ও রূপচাঁদা। বর্তমানে মানভেদে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৬শ' থেকে ১১শ' টাকা, ফাইস্যা ৪শ' থেকে ৭৫০ টাকা, ছুরি ৭শ' থেকে ১৬শ' টাকা, ছোট চিংড়ি ৮শ' থেকে হাজার টাকা, ছোট পোয়া ৫শ' থেকে ৭শ' টাকা, রইস্যা ৬শ' থেকে ৭শ' টাকা, রূপচাঁদা ১৭শ' থেকে ২৪শ' টাকা, লাক্ষা ১৮শ' থেকে ২৬শ' টাকা, মাইট্যা ৮শ' থেকে ১২শ' টাকা, বড় চিংড়ি (চাগাইচা) ১৭শ' থেকে ২ হাজার টাকা, কোরাল এক হাজার থেকে এক হাজার ৮শ' ও অন্যান্য ছোট মাছ ৪শ' থেকে ৮শ' টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কক্সবাজারের উপকূলে উৎপাদিত শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রতি মৌসুমে শুধু নাজিরারটেক মহালে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদিত হয়। এসব শুঁটকির উলেস্নখযোগ্য একটি অংশ রপ্তানিও হচ্ছে। সরকার পাচ্ছে বড় অংকের রাজস্ব।
জেলা মৎস্য কর্মকতা বদরুজ্জামান বলেন, '২০১২-১৩ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর- এই ১১ বছরে প্রায় ৭ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ২৬৩ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। সেই হিসাবে বছরে গড়ে প্রায় ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই বছর প্রায় ৮৬ লাখ ৬৫১ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছিল। আর উলেস্নখিত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম হয়েছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে, প্রায় ৪২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৪ ডলারের শুঁটকি রপ্তানি হয়েছে।'