বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে ২০২৪!

বৈশ্বিক উষ্ণতায় হুমকিতে পৃথিবী

প্রকাশ | ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পৃথিবী। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষ হত্যা করছে। জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করছে। ঘরবাড়ি, ব্যবসা, খামার নষ্ট করে দিচ্ছে। চরম আবহাওয়া পরিস্থিতিতে ইউরোপে গত তিন দশকে মারা গেছে প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। শুধু প্রাণহানিই নয়, এ কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৫৬০ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। খরার কারণে আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে ৫ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্তৃত পরিসরে আরও ১০ কোটি মানুষের ক্ষতি হয়েছে। গরমে অতিষ্ঠ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনজীবন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবী যেন হয়ে উঠছে এক ঝলসানো রুটি। এমন ভয়াবহ তান্ডবের পর ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতম বছর, এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডবিস্নউএমও)। সোমবার আজারবাইজানের বাকুতে ১২ দিনের বিশ্ব জলবায়ু বিষয়ক, কপ-২৯ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সিমন স্টিল বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১৯ শতকের শেষের দিকের তাপমাত্রার তুলনায় প্রায় ১ দশমিক পাঁচ-চার সেন্টিগ্রেড বেশি। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তাপমাত্রা রেকর্ড শুরু হয়। এরপর থেকে শত বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩। তবে চলতি বছর তা রের্কড ভেঙ্গে ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণতম বছর। এবার সম্মেলনে নতুন জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষে বিশ্বনেতাদের একমত হতে হবে। একই সঙ্গে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ দেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে, প্রতিটি দেশকেই চরম মূল্য দিতে হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস)। জলবায়ু নিয়ে কাজ করা এই সংস্থা জানায়, ২০২৩ সালে রেকর্ড গরম ছিল। চলতি বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে মানবসৃষ্ট কার্যক্রম ও এল নিনোকে দায়ী করা হচ্ছে। গত জুনের আগের ১২ মাসে গড় তাপমাত্রা ছিল প্রাক-শিল্প যুগের পর গড়ের চেয়ে ১ দশমিক ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বছরের শুরুতেই তীব্র গরম আর দাবানলে পুড়ছে ইউরোপ থেকে আমেরিকা। একই সময়ে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ে কানাডা। দাবানলে পুড়ে স্পেনের তেনেরিফে দ্বীপও। পুড়ছে ফ্রান্স ও পর্তুগালের মতে দেশগুলো। এছাড়া স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির বিভিন্ন অঞ্চল। আগুনে পুড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া ও অস্ট্রেলিয়া। এমন পরিস্থিতিতে দেশে দেশে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে শুরু করে পূর্বাঞ্চলের কিউবেক পর্যন্ত ভয়াবহ রূপ নিয়ে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে। প্রায় ৩৫০ বছরের পর এমন রেকর্ড গরম ও দাবানলে পুড়ে পৃথিবী। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উষ্ণতম বছরের রেকর্ড করেছে ২০২৩ ও ২০২৪ সাল। বাংলাদেশ ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গরমের বছর পার করছে। বিশ্বের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল আফ্রিকার শিং হিসেবে খ্যাত পূর্ব আফ্রিকায় গত টানা ৩ বছর ধরে খরা চলছে। ফলে, সেই অঞ্চলে সোমালিয়া, ইথিওপিয়া ও কেনিয়ার বিস্তৃত এলাকায় ফসলহানির পাশাপাশি পানির তীব্র সংকট চলছে। গবাদিপশুগুলো খাবারের অভাবে শুকিয়ে মরছে। এই খরাকে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হিসেবে উলেস্নখ করে সিএনএন জানায়, এর প্রভাব মানুষের ওপর চরমভাবে পড়ছে। সেখানে মারা গেছেন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। এ ছাড়া, ২ কোটি মানুষ পড়েছেন তীব্র খাদ্য সংকটে। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানি তথা তেল, গ্যাস ও কয়লাকে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। কেননা, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৭৫ শতাংশ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে এগুলোর অবদান ৯০ শতাংশ। এতে আরও বলা হয়, গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো পৃথিবীকে চাদরের মতো মুড়িয়ে রাখে বলে সূযের্র তাপ বায়ুমন্ডলে আটকে যায়। ফলে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দেয়। উষ্ণায়ন মানবজাতিসহ পুরো প্রাণিজগতের অস্থিত্ব হুমকিতে ফেলেছে। গত বুধবার ইউরোপিয়ান এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (ইইএ) বরাত দিয়ে ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর এ তথ্য জানিয়েছে। আবহাওয়ার এমন আচরণ শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া। ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বে ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গরমের বছর। আর ২০২৪ সাল প্রায় চারশ' বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এশিয়ার দেশগুলোতে খরায় পুড়ে ফসলের মাঠ। ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্র রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 'এল নিনো' ও 'লা নিনো' জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খরা, তাপদাহ ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী এল নিনো ও লা নিনা। লা নিনো অথবা লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল পানি ও উষ্ণ পানির তারতম্য বিশ্লেষণ করে পেরুর জেলেরা এল নিনো ও লা নিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পান। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব রয়েছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের আবহাওয়া এল নিনো এবং লা নিনার প্রত সংবেদনশীল। পেরু ও চিলির প্রপ্রন্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্যতিক্রমী উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোত পর্যায়ক্রমে এল লিনো ও লা লিনো ভারত সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মৌসুমি বায়ুকে প্রভাবিত করছে। তাই বলা হচ্ছে, এল নিনো ও লা নিনা পরক্ষোভাবে বাংলাদেশের জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালের বন্যায় বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে লা নিনা ছিল ওই বন্যার অন্যতম কারণ। বলা হচ্ছে- ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বা তেতালিস্নশের মন্বন্তরের কারণ ছিল এল নিনো। বাংলাদেশে যেসব বছরে খরা হয়েছে যেমন- ১৯৭৩-৭৪, ১৯৯৭, ২০১৭,২০১৯, ২০২৩ বছর ছিল এল নিনোর বছর। আবার যে বছরগুলোতে বন্যা হয় যেমন- ১৯৭০, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৬, ২০১৭ ও ২০২০ বছরগুলো ছিল লা নিনার বছর। আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং কার্বন নিঃসরণ রোধে কার্যক্রম চালিয়ে যাবার কথা জানিয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের প্রতিনিধি জন পোদেস্তা। তবে বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এ প্রতিশ্রম্নতিকে পাত্তা দিচ্ছে না, বরং তারা মনে করছে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি ট্রাম্পের কারণে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বছরে ১০০ বিলিয়নের অর্থ পায়নি। ফলে এবার জলবায়ু সম্মেলনে কোনো সাফল্য আসবে না বলেই মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। কারণ এবার সম্মেলনে সর্বাধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখনো উপস্থিত হননি। তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভস্নলাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জলবায়ুর প্যাটার্ন এল নিনো আবারও ফিরে আসায় ২০২৪ সাল বিগত বছরের চেয়েও আরও বেশি গরম অনুভূত হয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবজাতি এখনো বিপুল পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমন্ডলে ছাড়াতে থাকায় ২০২৩ সালের চেয়েও ২০২৪ সাল আরও বেশি গরম হয়েছে। এ তথ্য জানান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট শীর্ষক প্রতিবেদনে আবহাওয়াবিদ সামান্থা বার্জেস।