জনপ্রশাসনের বাধা

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন হচ্ছে

কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা নেই এমন মতামত দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, কমিশন করতে হলে আইনের পরিবর্তন করতে হবে, যা কঠিন কাজ

প্রকাশ | ২৪ মে ২০১৯, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জটিলতা কমাতে একটি কমিশনের অধীনে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য পৃথক একটি কমিশন গঠন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কমিশনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো স্বাধীন একটি সংস্থা হবে। সেখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। এটি হলে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ মেধার প্রতিফলন ঘটবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও এটি বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাধা মুখে পড়তে হচ্ছে। কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা নেই এমন মতামত দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, কমিশন করতে হলে আইনের পরিবর্তন করতে হবে, যা কঠিন কাজ। তবে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার চাইলে সব সম্ভব। শুধু সদিচ্ছা দরকার। জানা গেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিদর্শনকালে শিক্ষক নিয়োগে আলাদা একটি কমিশন গঠনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষক নিয়োগের কাজটি দৈনন্দিন বিধায়, এটি জটিল বিষয়। আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) হয়ে আসতে আসতে অনেক সময় লাগে। এ জন্য আমার একটা প্রস্তাব আছে। এ বিষয়ে কাজও হচ্ছে। আমি মনে করি, শিক্ষক নিয়োগে একটা আলাদা কমিশন হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, কমিশন ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ বিদ্যমান সমস্যা সমাধান সম্ভব না। তাই কমিশনের বিষয়ে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। যেকোন জটিলতা এড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পরও ৪ বছর থেমে ছিল কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা আসার পর কমিশন নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেন নতুন সচিব আকরাম-আল-হোসেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ে মাস্টার পস্নান করেন যেখানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের বিষয়টিতে জোর দেন। তারই ধারাবাহিকতায় ফেব্রম্নয়ারি মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্বয়ক বৈঠকে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) পলিসি ও অপারেশন বিভাগকে নির্দেশ দেন। সেই প্রতিবেদন ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আলোকে কমিশনের গঠনের মতামত চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের না সূচক জবাব দিয়ে বলেছে, আপাতত কমিশন গঠনের কোনো প্রয়োজনীতা নেই। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, তিনি সচিব হিসেবে আসার পর কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেন। সে জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি দেন। কিন্তু সেখান থেকে না সূচক জবাব আসে। কমিশন গঠনের কোনো সুযোগ নেই বলে তারা জবাব দিয়েছে। যেহেতু প্রধামন্ত্রীর নির্দেশনা দিয়েছেন তাই এটার পিছনে লেগে আছেন। প্রধানমন্ত্রী আবার প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের সফরে আসছেন। তখন বিষয়টি আবার তোলা হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে সবেচেয়ে বেশি নিয়োগ হয় প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ। গত ৫ বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আরও ১৩ হাজার শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ১৩ হাজার আবেদনের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ২৪ লাখের বেশি। প্রতি আসনের বিপরীতে লড়বেন ২০০ বেশি চাকরি প্রার্থী। এ বিশাল আবেদনকারীদের নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন অধিদপ্তর। শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা নিতে গিয়ে কয়েক দফায় সময় পিছিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। চার দফা পরীক্ষার সময় পিছানোর পর সর্বশেষ রমজান মাসে ৫ম দফা সময় পিছানো হয়েছে। ঈদের পর এ পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। প্রাথমিক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে প্রাথমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন, চাকরিপ্রার্থী ও পরিদর্শককের সিট বণ্টন, খাতা মূল্যায়নসহ সব কিছুই বুয়েট হাতে। প্রধান শিক্ষকদের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণি হওয়ায় তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে লম্বা সময় লেগে যায়। তবে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব বুয়েটকে দেয়ার পর শিক্ষক নিয়োগে কোনো বির্তক তৈরি হয়নি। বুয়েটের তত্ত্বাবধানে প্রায় সবকটি নিয়োগে স্বচ্ছতা ছিল। কারণ হিসেবে কর্মকর্তারা বলছেন, বুয়েট পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজের আওতার এনেছে। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আসন বণ্টন করে থাকে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। যেখানে কারও জানার সুযোগ নেই কার আসন কোথায় পড়বে। পরীক্ষা হলে পরিদর্শকরা কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন সেটি হয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে। একই সঙ্গে পরীক্ষার্থীদের আসন বন্টন অনুযায়ী প্রশ্নের সেট নির্ধারণ করা হয় কোর্ডিং সিস্টেমে। বিশেষ কোড দিয়ে পরীক্ষার দিন সকাল বেলায় প্রশ্নপত্র পাঠানো হয় কেন্দ্রে এবং সকালে উপজেলায় সেই প্রশ্নপত্র প্রিন্ট দেয়া হয়। তাই আগের মতো রাতে বা দুই দিন আগে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা নেই বললেও চলে। ডিপিই কর্মকর্তারা বলছেন, এক সময় প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রকাশ্যে প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষার হলে লেখে দেয়া থেকে চাকরি দেয়া পর্যন্ত কন্ট্রাক্ট নিতেন দালাল চক্র। বুয়েটকে দায়িত্ব দেয়ার পর সেটির পরিবর্তন হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় প্রায় শতভাগ স্বচ্ছতা আসার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, থার্ড পার্টিকে দিয়ে কতদিন এভাবে পরীক্ষা নিবো। এ জন্য তারা চান শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি স্থায়ী কমিশন হোক। এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর এটি নিয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। গত কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠেনি। তারপরও তারা চান আরও স্বচ্ছতা আসুক। এ জন্য কমিশন গঠন করলে স্থায়ী একটি সমাধান হয়ে যায়।