বোরো আবাদের জমি তৈরিতে ব্যস্ত কৃষক -ফাইল ছবি
আমনের বাম্পার ফলন ও ভালো দামে খুশি কৃষকরা। সেই খুশির রেশ ধরেই বোরো আবাদে মাঠে নেমেছেন তারা। শীতের কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা জমিতে হাল চাষ ও বোরোর বীজতলা তৈরি করছেন। আবার কোথাও কোথাও বীজ রোপণ করা হয়েছে। এখন তাদের প্রয়োজন সার, সেচের জন্য ডিজেল ও বিদু্যৎ। প্রায় প্রতি বছরই প্রয়োজনীয় সার, ডিজেল ও বিদু্যৎ না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে কৃষকের। তাই এবার আগেই বোরো আবাদে সেচ কাজে সার ও ডিজেল প্রণোদনা, বিনামূলে উন্নত জাতের বীজ ধান ও নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যতের দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
সারা দেশে আমন ধান কাটার পর বোরো ধান আবাদের প্রস্তুতি চলছে। এখন সার, বীজধান ও সেচের প্রয়োজন। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে বোরো আবাদে সেচের জন্য বিদু্যতের জরুরি প্রয়োজন। বোরো ধান উৎপাদন পুরোপুরি সেচনির্ভর। গেল দুই বছর উৎপাদন মৌসুমে বিদু্যৎ না পাওয়া কৃষকরা এবার বোরো আবাদে সেচ কাজে ডিজেল ভর্তুকি ও নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যতের দাবি জানিয়েছেন। বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনে সেচ খরচ হয় ৪৬ শতাংশ। মৌসুমের শুরুতে ধান ক্ষেত প্রস্তুত করতে সেচের জন্য বিদু্যৎ, ডিজেল ও সারের প্রয়োজন হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আমন ধানে লাভ পেয়ে এবার তীব্র শীত উপেক্ষা করে বোরো আবাদে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন কৃষক। ধানের এলাকা হিসেবেখ্যাত হাওড় অঞ্চলে চলছে বোরো আবাদের ধুম। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, মাগুরা, কুমিলস্না, কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো ও কৃষকরা প্রচন্ড শীত ও হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বোরো ধান রোপণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
কুয়াশার আঁচল বিছানো গ্রামের মাঠে শিশিরভেজা ঘাসের পাতায় রোদের ছোঁয়া লাগেনি। ভোরের ফকফকা আলো পুব আকাশে উঁকি দেয়নি। ময়মনসিংহ-বিরিশিরি সড়কের শ্যামগঞ্জ বাজারের পাশে কৃষক আকবর আলী খালি পায়ে হাঁটছেন তার ধানের ক্ষেতের আইল ধরে। মোটর সাইকেল থামিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, সরকারি ধানের বীজ না পেয়ে একটি কোম্পানির বীজ ধান তিনি রোপণ করেছেন। আমন ধান বিক্রির টাকায় হালচাষ ও বীজ ধান কিনছি। এখন হাতে টাকা নাই, আমরা নতুন সরকারের কাছে সার ও ডিজেলর খরচ কমানোসহ সরকারের কাছে ভর্তুকি দাবি জানাই। প্রত্যেক বছর বিদু্যৎ আসে আর যায়। এতে ধান ক্ষেতে পানি দেওয়া যায় না। ফলন কম হয়। তাই এইবার রাতে একটানা বিদু্যৎ দেওয়ার জন্য দাবি জানাই।
সরেজমিন দেখা যায়, শীত আর হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে ধোবাউরার কলসিন্দর গ্রামের কৃষকরা বোরো ধানের মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। শীত ও কুয়াশায় বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কার অনেকে দ্রম্নত বাজ রোপণের কাজ শেষ করছেন।
এ গ্রামের কৃষক আব্দুল আলী বলেন, প্রতি বছরই সেচের জন্য পাম্পে বিদু্যৎ থাকে না। এক কাঠা (৮ শতাংশ) জমিতে সেচের পানি দিতে হয় ৮শ' টাকার। নিয়ে সেচ পাম্পের মালিক ও কৃষকদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঝগড়া-বিবাদ হয়। আমরা এবার সরকারর কাছে সার, ডিজেল ও বিদু্যতের জন্য প্রণোদনা চাচ্ছি। সরকার জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত গ্রামে নিয়মিত বিদু্যৎ দিলে আমরা ভালোভাবে ধান ঘরে তুলতে পারবো।
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সীমান্ত এলাকা বারমারি গ্রামে কথা হয় কৃষক শহীদ, ভাস্কর রিছিল,
সুকুমার হাজং ও আইনাল হকের সঙ্গে। তারা সেচের জন্য ডিজেলে ভর্তুকি চেয়েছেন। মৌসুমের শুরুতে প্রণোদনার অর্থ না পেলে উৎপাদন খরচে তারা কুলিয়ে ওঠতে পারবেন না।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সেচের পিক সিজন। সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে সেচে বিদু্যৎচালিত পাম্পের ব্যবহার বাড়লেও এখনো বিপুলসংখ্যক কৃষক ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করেন। দেশের এক কোটি ২৩ লাখ কৃষক ডিজেলচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে সেচকাজ পরিচালনা করেন। দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল পাম্প এবং ২ লাখ ৭০ হাজার বৈদু্যতিক পাম্প রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১৬ লাখ টন ডিজেল সেচে ব্যবহার করা হয়।
নওগাঁ সদর উপজেলার চকপ্রাণ গ্রামের কৃষক আনছার উদ্দিন বলেন, সমিতির টাকা নিয়ে চাষে নামছি। এখন নগদ টাকার প্রয়োজন। সার, বীজ ধান ও ডিজেল নগদ টাকায় কিরতে হয়। কৃষি মজুরদের দৈনিক ভিত্তিতে টাকা দিতে হয়। তাই সরকারের কাছে নগদ ভর্তুকি চাই। এই মৌসুমে বিদু্যৎ খুব ঝামেলা করে। একই সময়ে সবার ক্ষেতে পানি দিতে হয়। অথচ রাতের পর রাত বসে থেকে বিদু্যতের অভাবে ধান ক্ষেত শুকিয়ে গেলেও পানি দিতে পারি না।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য বলছে, বোরো মৌসুমে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার হয় বেশি। উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড চাষে বেশি সেচ দিতে হয়। এতে খরচ আরও বৃদ্ধি পায়। ডিসেম্বর মাসে ধানক্ষেত প্রস্তুতের সময় সেচের জন্য ডিজেলের প্রয়োজন হয় প্রায় দুই লাখ টন। জানুয়ারি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টন ডিজেল ব্যবহার হয়। আর ফেব্রম্নয়ারিতে ব্যবহার হয় প্রায় পাঁচ লাখ টন। মার্চ মাসে সেচে ডিজেল লাগে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টন। এপ্রিল আর মে দুই মাসে ব্যবহার হয় চার লাখ টন ডিজেল।
কৃষি ও সমবায় আন্দোলনের সভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, দেশের মোট চালের ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। বোরো আবাদ সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। ফলে এ ধান চাষে মোট খরচের অর্ধেকর বেশি ব্যয় হয় সেচকাজে। তাই সারা দেশের কৃষকরাই এবার ধান চাষে সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ এর দাবি জানাচ্ছে। প্রতি মৌসুমে কৃষকরা সেচের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কৃষক। তাই এবার ডিজেলে নগদ ভর্তুকি দাবি করেছেন। কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানান এই কৃষক নেতা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বোরো মৌসুমে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ করা হচ্ছে। বোরো মৌসুমে উৎপাদনের টার্গেট ধরা হয়েছে দুই কোটি টনের বেশি।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বছরে সারাদেশে ২৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বোরো মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ১৪ লাখ টন। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয় ৩ লাখ ৯৬ হাজার টন। ফেব্রম্নয়ারিতে সার ব্যবহার হয় ৪ লাখ ১৫ হাজার টন আর মার্চ মাসে প্রয়োজন হয় প্রায় আড়াই লাখ টন। ইতোমধ্যে সরকার বোরো মৌসুমের জন্য ১৭ লাখ টন সার মজুত করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাবে, বোরো মৌসুমে দেশে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে বিদু্যতে চলে এক লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদু্যতে চলে এক লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদু্যতে চলে।