বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয়ের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে চলতি বছর। দীর্ঘ এ সময়ে এদেশে আশ্রিত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে এ বছর প্রতিবেশী চীনের নেওয়া তৃতীয় দফার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সামরিক জান্তা বাহিনীর গৃহযুদ্ধ চলায় রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হয়ে পড়ে। যুদ্ধের কারণে এ বছর বহু রোহিঙ্গা এবং দেশটির সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিজিপি) পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে আন্তর্জাতিক নানা চাপে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল এ বছরের শুরুর দিকে কয়েক দফা কক্সবাজার উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিদর্শন করে প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে।
এদিকে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা ও প্রতিশ্রম্নতির আশ্বাস দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টারা বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে নানা নাটকীয়তা ও প্রতিশ্রম্নতির ভেতর দিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে ২০২৪ সাল।
পথনকশা আহ্বান ঢাকার
চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এক অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সভায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পথনকশা করার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি মিয়ানমারে শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য আঞ্চলিক জোট আসিয়ান এবং অন্যান্য প্রধান আঞ্চলিক পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় তিনি রাখাইন রাজ্যের অর্থনীতি পুনর্গঠনসহ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তার প্রস্তাব দেন।
এই সভায় তিনি জানান, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে বাড়তি ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সভায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সীমান্ত এলাকায় চলমান সশস্ত্র সংঘাতের পাশাপাশি নানা ধরনের অপরাধ, মাদক ও অস্ত্র পাচারের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানান। এছাড়া তিনি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া রোহিঙ্গাবিষয়ক তিন দফা প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গা ইসু্যতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্যের অভাব
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মিয়ানমারে, বিশেষ করে রাখাইনে গৃহযুদ্ধ চলায় রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এ ইসু্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য না হওয়ায় সংকটের সমাধান হয়নি। বিশ্ব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।
রোহিঙ্গা নীতির প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যবিষয়ক ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সংলাপে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব মন্তব্য করেন। সংলাপে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, গণমাধ্যম, রোহিঙ্গা নেতাসহ বিভিন্ন পক্ষ অংশগ্রহণ করে। সংলাপের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
এই সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আবদুল হাফিজ বলেন, 'রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভক্তি, কার্যকর নেতৃত্বের অভাব ও রাখাইনে নিবর্তনমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না ওঠা তাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।'
এদিকে, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) ঊর্ধ্বতন গবেষক ও মিয়ানমারে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান বলেন, 'জাতিসংঘ রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশে যতটা তৎপর, মিয়ানমারের ভেতরে ততটা তৎপর নয়। রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি জরুরি।'
তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে জন্মভূমি থেকে পালিয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়। সেই রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। এ বছর বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও মিয়ানমারে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ চলায় আরও ৬০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নেয়। যা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
রোহিঙ্গাদের এই অনিশ্চিত জীবনযাত্রায় শুরু থেকেই হতবাক হয়েছে বিশ্ব। অসংখ্য মানুষের অজানা পথ পাড়ি দেওয়ার হৃদয়স্পর্শী সেই মুহূর্তগুলো এখন রূপ নিয়েছে কষ্টের এক ভয়াল জীবনে। পরিণত হয়েছে দীর্ঘশ্বাসে। মিয়ানমারের প্রতিশ্রম্নতি আর বাংলাদেশের নানামুখী প্রচেষ্টার পরও এ সময়ের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা ফিরতে পারেননি তাদের নিজের বাসভূমে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাব পাস
চলতি বছরের জুলাইয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাব পাসের পর রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে আশা জেগেছিল। কিন্তু এরও কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল যুদ্ধের কারণে দেশটিতে বাস্তুচু্যত রোহিঙ্গার সংখ্যা আরও বেড়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন উপযুক্ত সময় নয়। আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নাজুক পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে বড় বাধা। বাংলাদেশেও ঘটে গেছে ক্ষমতার পালাবদল। বিশ্লেষকদের মতে, সব মিলিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইসু্যটি এ বছর গভীর সংকট হয়েই থেকে গেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নানা প্রতিশ্রম্নতি
আগামী দুই বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, মিয়ানমারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো শহর বিদ্রোহীরা দখল করছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছেন। ফলে এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। জাতিসংঘও বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে সহায়ক নয়। এরপরও সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা সাক্ষাত করতে এসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন।
মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবিতে সমাবেশ
চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পের নিজ দেশে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবিতে সমাবেশ করেন রোহিঙ্গারা। বাস্তুচু্যত এসব রোহিঙ্গারা শরণার্থী জীবন থেকে মুক্তি পেতে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে স্বদেশে ফেরত যেতে প্রস্তুত বলে জানান।
বক্তারা বলেন, 'মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে; এর ন্যায়বিচার চাই। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা জনগণের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।'
মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিষয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, 'আমরা আর শরণার্থী জীবন চাই না। সামনের দিনগুলোয় আমরাও আমাদের জন্মভূমি আরাকানে জীবনযাপন করতে চাই। বিশ্ব সম্প্রদায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যাপারে যেন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়।'
এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা উদ্যোগের কথা বলেছে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কোনো কিছু পরোয়া করছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি যে ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক হবে, সেটা উঠে এসেছে থাইল্যান্ডে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়। তিনি বলেছেন, 'এখন বয়স্ক যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা হয়তো পরিস্থিতি মেনে নেবেন। তবে আগামী ৫ বছর পর যেসব রোহিঙ্গার বয়স ২০ বছর হবে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবেন।'
বাংলাদেশ শুরু থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বিশ্বসম্প্রদায়কেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ ও অন্য বহুপক্ষীয় ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টিতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মিয়ানমারের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারতকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ন্যায়সংগত দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আরাকান আর্মির মতো আরও অনেক বিদ্রোহী গ্রম্নপ মিয়ানমারে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। কাউকে শক্তি-বলে নিবৃত্ত করতে চাইলে তারা ভুল করবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে, সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।