দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ -ফাইল ছবি
তিস্তা ব্যারাজ কমান্ড এলাকার সেচ সক্ষমতা বাড়াতে সংস্কার কাজ চলছে। এতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ হলে ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে এ এলাকার কৃষকরা এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাবেন।
এছাড়া ইতোমধ্যে সেচ খালের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ায় আসন্ন বোরো মৌসুমে ৫৫ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাপাউবো সূত্র জানায়, সেচ প্রকল্পের খাল নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ থেকে শুরু হয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২ উপজেলায় বিস্তৃত। সেচ খালের দৈর্ঘ্য ৭৬৬ কিলোমিটার। উত্তরাঞ্চল খরাপীড়িত হওয়ায় ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে এর মুল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৩ সালে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীরা দেশীয় প্রযুক্তি এবং জনবল দিয়ে জরিপ, পরিকল্পনা ও ডিজাইন প্রণয়ন করে মডেল স্টাডির ভিত্তিতে তিস্তা ব্যারাজের বর্তমান স্থান নির্ধারণ করেন।
ব্যারাজের ক্যানেল সিস্টেমের নির্মাণ কাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে হাতে নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালের জুন মানে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। তিস্তা ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার, গেট ৪৪টি। ক্যানেল হেড রেগুলেটর ১১০ মিটার দীর্ঘ, গেট ৮টি। মোট গেট ৫২টি।
জানা যায়, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (ফেজ-১) সেচ সুবিধার আওতায় আনা হয় নীলফামারী জেলার নীলফামারী সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর জেলার রংপুর সদর, গঙ্গাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ এবং দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা উপজেলা। প্রধান খাল ৩৩ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার, মেজর সেকেন্ডারী খাল (দিনাজপুর ও রংপুর) ৭৪ দশমিক ৪৩ কিলোািমটার, শাখা খাল/সেকেন্ডারী খাল ২১৪ দশমিক ৭০ কিলোমিটার, উপ-শাখা খাল/টারশিয়ারী খাল ৩৮৭ দশমিক ৬৫ কিলোািমটার, কিঃমিঃ, নিষ্কাশন খাল ৩৮০ কিলোািমটার। প্রধান খালে পানি সরবরাহ ক্ষমতা ২৮৩ কিউসেক।
প্রায় সব খাল নীলফামারীর ওপর দিয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় গেছে। প্রথম পর্যায়ের সেচ যোগ্য এলাকা ১ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর ধরা হলেও বাস্তবায়িত হয়েছিল ৯১ দশমিক ২২৬ হেক্টর। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সংস্কার কাজ না হওয়ায় গড়ে ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি সেচ পেত না। সেচের সক্ষমতা বাড়াতে নতুনভাবে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাই থেকে।
বাপাউবো সুত্র মতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) 'তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও পরিবর্ধন প্রকল্প' এটি।
এই প্রকল্পের অধীনে সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ চলমান। বিভিন্ন কারণে কাজ পিছিয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মূলত বর্ষাকালে অনাবৃষ্টির ফলে খরা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এই প্রকল্প হলেও নতুন করে আমূল সংস্কারের কাজ শেষে ২০২৭ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমেও বোরো চাষের জন্য সেচ সুবিধা পাবে পুরো প্রকল্প এলাকার কৃষক। এ জন্য তিস্তা ব্যারাজের উজানে খননের আরও একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়াতে আরও প্রায় ৫০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলছে।
বাপাউবোর উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, 'এই প্রকল্পটি বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতার আংশিক ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে।'
এদিকে, তিস্তা কমান্ড এলাকা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষায় ব্যারাজের সক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি আসায় বন্যা ও ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রকল্প ও প্রকল্প এলাকার মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমের পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় খরায় পোড়ে ফসল। ৯০-এর দশক থেকে অভিন্ন এই নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে উজানের প্রতিবেশী দেশ ভারত।
প্রকল্প এলাকার কৃষকরা জানান, অনাবৃষ্টি ও খরায় সময় তিস্তা সেচ প্রকল্প আর্শিবাদ বয়ে আনে। আমন ধান বৃষ্টি নির্ভর আর বোরো ধান সেচ নির্ভর। প্রতি একরে সেচ খরচ মাত্র ১৮৯ টাকা।
কৃষকরা বলেন, তিস্তা সেচ প্রকল্পের অধীন পুরাতন ও ক্ষতিগ্রস্ত সেচ নালা সংস্কার ও পুনর্বাসনের ব্যাপক কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ শেষ হলে আগামীতে আরও বেশি এলাকা সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। এদিকে তিস্তা প্রকল্পের সুবিধাভোগী কৃষকরা জানায়, নদীতে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন প্রবাহ ঠিকঠাক থাকলে বোরো আবাদে সেচ পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
রংপুর কৃষি অঞ্চল কার্যালয় সুত্রে জানানো হয়, এবছর চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৪৬ হেক্টরে, গাইবান্ধায় ১ লাখ ২৯ হাজার ১৫ হেক্টরে, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৬০ হেক্টরে, লালমনিরহাটে ৪৮ হেক্টরে ও নীলফামারী জেলায় ৮১ হাজার ৮৯৭ হেক্টরে। এই পরিমান জমিতে বোরো আবাদের জন্য ২৬ হাজার ৫৯২ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরী করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো আবাদ হলে রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় ২২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৫ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে।