সাকরাইন উৎসব উপলক্ষে শাঁখারীবাজারে সেজেছে ঘুড়ির দোকান -সংগৃহীত
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিন আজ পুরান ঢাকার বাসিন্দারা মেতে উঠবেন ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবে। পৌষ মাসের শেষে ও মাঘের শুরুতে শীতের বার্ষিক উৎসবকে যে নামে পালন করা হয় তা 'সাকরাইন উৎসব' হিসেবে পরিচিত। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠেন এ উৎসবে। এই দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা 'পৌষসংক্রান্তি' পালন করেন। পুরান ঢাকায় যা 'সাকরাইন' উৎসব। সাকরাইন উৎসবে মূলত রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়ানো হয়। পাশাপাশি আয়োজন করা হয় পিঠা-পুলিসহ ঐতিহ্যবাহী নানা খাবারের।
সংস্কৃত শব্দ 'সংক্রান্তি' ঢাকাইয়া অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এ উৎসব ভিন্ন ভিন্ন নামে উদযাপন করা হয়। বাংলায় দিনটি পৌষ সংক্রান্তি ও ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি হিসেবে পরিচিত।
এই দিনে পুরান ঢাকার রুপলাল দাস লেন, শ্যামবাজার, শাঁখারি বাজার, রায়সাহেব বাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, বাংলাবাজার, সদরঘাট এলাকার মানুষ সারাদিন
ঘুড়ি ওড়ান। আয়োজন করা হয় পুরান ঢাকার নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের। সাকরাইন উৎসবকে ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়। এ উৎসবে অংশ নেন সব ধর্ম-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এ উৎসব।
বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব অন্যতম। যদিও এটা সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী পালিত হয় না। কিন্তু এটি খুব জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সংস্কৃতি। এটাকে ঐক্য এবং বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমানে এ উৎসবে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। অর্থাৎ সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে আতশবাজী ও ফানুস উড়ানো। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসব এলাকায় চলবে আতশবাজীর খেলা। সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো একটি অবশ্য পালনীয় অঙ্গ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হয় আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে।
সোমবার দেখা যায়, পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, লক্ষ্ণীবাজার, নয়াবাজার, তাঁতীবাজার, গেন্ডারিয়া ও সূত্রাপুর এলাকায় ঘুড়ি, নাটাই ও মাঞ্জা দেওয়া সুতা বেচাকেনার ধুম পড়েছে। শাঁখারিবাজারে খুচরা দামে ঘুড়ি বিক্রেতা দেবাশীষ পাল বলেন, '?গত বছরের তুলনায় এবারের বেচাকেনা ভালো হচ্ছে। আমার দোকানে ১০ টাকা থেকে শুরু ৪০০-৫০০ টাকার ঘুড়ি এবং ৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকার নাটাই রয়েছে।'
পুরান ঢাকার বাসিন্দা শাকিল বলেন, 'সাকরাইনের মূল আনন্দ হলো ঘুড়ি ওড়ানো। ছাদে উঠে আমরা ঘুড়ি উড়াই। অন্যের ঘুড়ি কেটে দেওয়ার মধ্যেই আসল মজা। তাই এবার ৩০টি ঘুড়ি ৪০০ টাকা দিয়ে কিনেছি।'
তিনি জানান, এই দিনে সকাল থেকেই পুরান ঢাকার প্রায় প্রত্যেকটি ছাদেই দেখা যাবে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। একজন অন্যজনের ঘুড়ি কাটবে, তার ঘুড়ি আবার অন্যজন কাটবে। দেখা মিলবে নানা রকম রঙিন ঘুড়ি, সুতা ও নানা রকমের নাটাই। এছাড়া সাকরাইন উৎসব ঘিরে সন্ধ্যার পর পুরান ঢাকার অলি-গলিতে এবং অনেক ভবনের ছাদে দেখা মিলবে ডিজে পার্টি। উচ্চৈঃশব্দে গানের তালে তালে নাচবে তরুণ-তরুণীরা। তবে এটিকে অনেকেই সাকরাইনের অপসংস্কৃতি বলে দাবি করেছেন।
এ বিষয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দা আরমাইন হোসেন বলেন, 'আমার জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা ঢাকায়। আগে ডিজে পার্টি না থাকলে ইদানীং ছেলেরা সাকরাইন উপলক্ষে ভবনের ছাদে ডিজে পার্টির আয়োজন করে। কিছু বলতে পারি না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকতে হয়।'
সাকরাইন উপলক্ষে নানা রকমের পিঠাপুলি ও বিভিন্ন স্বাদের খাবার রান্না করা হয় বাড়িতে বাড়িতে। সারা দেশে এই সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে থাকলেও সাকরাইন উপলক্ষে কিছুটা ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা জুলেখা বেগম বলেন, 'সাকরাইনের রাতে ছাদে গান-বাজনা চলে, আর ঘরে ঘরে ভালোমন্দ রান্না করা হয়। আসলে ছোট থেকে দেখে আসছি বলে এখন আর এই রান্নাবান্নার কাজটা বাদ দিতে পারি না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করা হয় আর কি।'