সপ্তাহব্যাপী উদযাপন শুরু

নিরাপদ সন্তান প্রসবে বড় বাধা ফিস্টুলা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারী সংখ্যা ২০ লাখ। এছাড়া প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি নারী নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন

প্রকাশ | ২৩ জুন ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ২৩ জুন ২০১৮, ১২:৩৮

জাহিদ হাসান
গামের্ন্টকমীর্ রেহনা খাতুনের (১৯) দাম্পত্য জীবন ২ বছরের। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু বিয়ের এক বছরের মাথায় প্রথম সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছেন নিদারুণ এক যন্ত্রণা। মেয়েলি রোগ বলে না পারছেন কাউকে বলতে, না পারছেন সইতে। সব সুখের হিতে আরেক অসুখের যন্ত্রণায় দাম্পত্য সুখ অধরা প্রায়। শেষতক ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারেন রোগটির নাম ফিস্টুলা। রোগটি সম্পকের্ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত বাল্য বিয়ের কারণে মেয়েদের গভর্ধারণকালীন জটিলতায় সিজার অথবা নারীদের জরায়ু অপসারণ অস্ত্রোপচারে অসতকর্তাবশত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে ফিস্টুলা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এসব রোগীর সবসময় প্রসাব বা পায়খানা ঝরতে থাকে প্রসবের রাস্তা দিয়ে। রাতে বিছানা ভিজে যাওয়ায় ও পরিধেয় কাপড় থেকে দুগর্ন্ধ ছড়ায় বলে ঘরের কাজে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু গোপনীয়তা ও অবহেলার কারণে চিকিৎসা নিতেও সংকোচবোধ করেন অনেকে। ফলে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিষন্নতায় বিপন্ন হয়ে উঠে আক্রান্ত নারীর জীবন। এমনকি অনেক ফিস্টুলা রোগী বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হয়ে পরিবার-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। তাই নিরাপদ সন্তান প্রসবে ফিস্টুলাকে বড় বাধা মনে করছেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসকগণ। এদিকে রেহেনার মতো ফিস্টুলা আক্রান্ত রোগীদের এমন দুবির্ষহ কষ্টের সত্যতা স্বীকার করে কয়েকটি হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ জানিয়েছেন, সাধারণত গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে সন্তানধারণ উপযোগী শরীর পরিপূণর্ হয়ে ওঠার আগেই অনেকে গভর্বতী হন। অসতকর্তা ও পরিবারের অবহেলার কারণে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছেও যান না। এতে করে দীঘের্ময়াদি প্রসবকালীন জটিলতা এবং অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে অনেক সমস্যা দেখা দেয় আবার নামকাওয়াস্ত ক্লিনিকে হাতুরে ডাক্তারের মাধ্যমে তলপেটে বা প্রসবের রাস্তায় অস্ত্রোপচার (সিজার) করে সন্তান প্রসব করে। তখন জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে প্রসবের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রসাব ঝরতে থাকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় এটিকে ফিস্টুলা রোগ বলে। রোগটি নিয়ে কাজ করা এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশের ফিস্টুলা কেয়ার প্রকল্পের এক্টিং গেøাবাল ফিল্ড ম্যানেজার ও দেশীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপক ডা. শেখ নাজমুল হুদার কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবারে মেয়েদের ১৫ বছরের মধ্যেই বিয়ে দেয়া হয় এবং ১৮ বছর পার না হতেই তারা সন্তান ধারণ করে। এদের বেশিরভাগই জানে না প্রসব-পূবর্বতীর্, প্রসবকালীন ও পরবতীর্ স্বাস্থ্য জটিলতাগুলো। মূলত ওইসব মায়েরাই অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে ভুল পদ্ধতিতে সন্তান প্রসবে অধিক হারে ফিস্টুলার ঝুঁকিতে থাকেন। এই বিশেষজ্ঞ আরও জানান, অনেক সময় জরায়ু ইনফেকশন অস্ত্রোপচারের সময়ে অসতকর্তাবশত নারীদের জননেন্দ্রীয় কেটে যায়। কোনো কোনো সময় যোনিপথ এবং পায়খানার মাঝখানের দেয়ালও ছিড়ে যেতে পারে। তখন যোনিপথ দিয়ে পায়খানা ঝরতে থাকে। যদি উভয় পাশের দেয়াল ছিড়ে যায় তাহলে পায়খানা এবং প্রসাব দুটোই ঝরতে পারে। অতিরিক্ত প্রস্রাব ঝরার কারণে তারা কম পানি পান করেন। সেক্ষেত্রে প্রস্রাবের ঘনত্ব বেড়ে যায়, বারবার প্রস্রাবের কারণে সংক্রমণ হয়। মূত্র থলিতে পাথর ও কিডনি বিকল হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। সব সময় প্রস্রাব আসার ফলে জননেন্দ্রীয়ের ত্বকে ঘা হয়ে যায়। এভাবে ফিস্টুলা একজন মহিলাকে সাংঘাতিকভাবে বিপযর্স্ত করে তোলে। যেটা কারও কাছে মৃত্যুর যন্ত্রণার মতো মনে বলে বিষন্নতায় ভোগেন এবং আত্মহত্যার কথা ভাবেন। প্রকল্পটির প্রোগ্রাম অফিসার নিত্য বিশ্বাস বলেন, গবেষণা অনুযায়ী দেশে এখনো প্রতিদিন গড়ে ১৪ জন মা প্রসবজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছে। কারণ এখনো ৬০ শতাংশেরও বেশি মায়ের প্রসব বাড়িতে হচ্ছে। অদক্ষ দাইয়ের হাতে প্রসবের কারণেই মৃত্যুসহ ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার আরও বেশি। মূলত ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে ৮০ শতাংশ, জরায়ু অপারেশনে ২০ শতাংশ ও অস্ত্রোপচার পরবতীর্ নানা আঘাতের কারণে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা কত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বেই মোট প্রসবের শতকরা ৫ শতাংশ প্রসব বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারী সংখ্যা ২০ লাখ। এছাড়া প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি নারী নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশের ‘ফিস্টুলা কেয়ার প্রকল্প’ ২০০৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে দেশে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৭ জন। তবে সম্প্রতি ২০১৬ সালে পরিচালিত মাতৃমৃত্যু ও প্রসবজনিত অসুস্থতা সম্পকির্ত জাতীয় সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে বতর্মানে বাংলাদেশে মহিলাজনিত ফিস্টুলা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৫০০ জন। ফিস্টুলা রোগের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানিছেন, চিকিৎসার মাধ্যমে ৮০ থেকে ৮৩ শতাংশ ফিস্টুলা নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু এই মুহ‚তের্ দেশে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন ফিস্টুলা বিশেষজ্ঞ সাজর্ন কাজ করছেন। তারা আশঙ্কা করছেন বতর্মানে যে হারে অপারেশন চলছে, এই হারে চলতে থাকলে সব ফিস্টুলা আক্রান্তদের অপারেশন শেষ করতে ৩০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। এদিকে বতর্মানে সরকারি ১১ এবং বেসরকারি ৮টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বিনামূল্যে ফিস্টুলা অপারেশন হচ্ছে। এসব চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভাসিির্ট ফিস্টুলা সেন্টার, মামস হাসপাতাল, বিজয় নগরের ডা. মুত্তালিব কমিউনিটি হাসপাতাল, আদ-দ্বীন হাসপাতাল (ঢাকা-খুলনা-যশোর), ল্যাম্ব হাসপাতাল (পাবর্তীপুর, দিনাজপুর), কুমুদিনি হাসপাতাল (মিজার্পুর, টাঙ্গাইল), ঢামেক হাসপাতালের ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার, কক্সবাজারের হোপ ফাউন্ডেশন হাসপাতাল। এছাড়া কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সেবা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য ২৩ মে আন্তজাির্তক ফিস্টুলা দিবস হলেও এ বছর দিনটি রমজান মাসে হওয়ায় ২৩ থেকে ২৮ জুন সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশে ফিস্টুলা সচেতনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে আর ২০৩০ সালের মধ্যে সারাবিশ্বে ফিস্টুলা অবসানে লক্ষ্য নিধার্রণে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় নিধার্রণ করা হয়েছে ‘বাদ যাবে না কেউ এই শপথে বলীয়ান’ আসুন সবাই মিলে করি ফিস্টুলা অবসান’।