সৈকতের নরম বালিতে ডিম পাড়তে আসা সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন অঞ্চল ধীরে ধীরে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। দূষণ, মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রজননস্থলেই মারা যাচ্ছে বিপন্ন প্রজাতির এসব কচ্ছপ। গত এক সপ্তাহে ভেসে এসেছে এমন ৯৯টি মৃত কচ্ছপ। এসব কচ্ছপ দল বেঁধে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে প্রজনন সময়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। বিপন্ন এই কচ্ছপগুলো রক্ষা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সামুদ্রিক বিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক দশক ধরে প্রজনন ক্ষেত্র অরক্ষিত হওয়ায় প্রতিবছর সৈকতে ডিম পাড়তে এসে মারা পড়ছে স্ত্রী কচ্ছপ। উষ্ণ বালির তাপমাত্রা ডিমের সুষম বিকাশকে প্রভাবিত করে, যা আগামী প্রজন্মের লিঙ্গ ভারসাম্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। চলতি প্রজনন মৌসুমে অর্ধশতাধিক ডিমওয়ালা কচ্ছপ মারা গেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সৈকতে মানুষের মলিনতা সৃষ্টি। পস্নাস্টিকের বর্জ্য, মাছ ধরার জাল, এবং অন্যান্য দূষণ থেকে সামুদ্রিক কচ্ছপকে রক্ষা করতে এবং সৈকতের প্রজননস্থল যেন ধ্বংস না হয় সেই জন্য আলোকায়ন অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রজননের মৌসুমে কচ্ছপের অস্বাভাবিক মৃতু্য নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরির) দেওয়া তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, পেঁচার দ্বীপ, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন সৈকতে ৯৯টি মৃত কচ্ছপের (অলিভ রিডলি) সন্ধান মিলেছে। সামুদ্রিক মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার সময় নভেম্বর থেকে এপ্রিল-মে পর্যন্ত। রাতে নির্জন স্থানে সমুদ্র থেকে এসে একটি গর্ত তৈরি করে প্রতিটি মা কচ্ছপ ৬০ থেকে ১০০টি ডিম পাড়ে। ডিম দেওয়া শেষে বালুমাটি চাপা দিয়ে মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে। ৬০-৭০ দিনের মধ্যে এই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে নেমে যায়।
বোরির তথ্য অনুযায়ী, উপকূলের আসার পথে মা কচ্ছপগুলো জেলেদের জালে, বড় নৌযানের ধাক্কায় আঘাত পেয়ে মারা পড়ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃতু্য নিছক একটি প্রাণীর ক্ষতি নয়, এটি সামুদ্রিক বাস্তুুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত। সামুদ্রিক কচ্ছপ দ্বীপরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। এরা বিপন্ন হলে তা পুরো খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
সৈকতে মানুষের কার্যকলাপ সীমিত করার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কচ্ছপের জীবন রক্ষায় স্থানীয় সংগঠন ও পরিবেশ সংরক্ষণ দলগুলো একত্রে কাজ করছে। তারা সৈকতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং বর্জ্য পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু এলাকাকে 'প্রজেক্ট কচ্ছপ' নামে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে কচ্ছপের ডিম এবং সদ্য ফোটা বাচ্চাগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বোরির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া জানান, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় কচ্ছপের ভূমিকা অপরিসীম। তাই, কক্সবাজার সৈকতে কচ্ছপদের জন্য একটি নিরাপদ প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে তুলতে সবাইকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।