শ্রমবাজারে মধ্যপ্রাচ্যনির্ভরতা বাড়ছে

২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬২ জন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩২ লাখ আট হাজার ৮৮ জন

প্রকাশ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
বিদেশে ইমারত নির্মাণের কাজ করছেন বাংলাদেশী শ্রমিকরা -ফাইল ছবি
বাংলাদেশের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। সেখানে লাখো কর্মী কাজ করছেন নির্মাণ, গৃহস্থালি ও সেবা খাতে। তার বিপরীতে ইউরোপের শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি খুবই সামান্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোর কঠোর অভিবাসন নীতি, দক্ষতার ঘাটতি এবং ভাষাগত দুর্বলতা বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিবেশী অনেক দেশ দক্ষ জনবল রপ্তানির মাধ্যমে ইউরোপের শ্রমবাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। ফলে নতুন শ্রমবাজার সম্প্রসারণ ও দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। শ্রমবাজার বন্ধ হলেও জনশক্তি রপ্তানির শীর্ষে মধ্যপ্রাচ্য:বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই জনশক্তির সিংহভাগ যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বন্ধ হয় বাহরাইনের শ্রমবাজার। অঘোষিতভাবে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। এছাড়া ২০২৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় ওমানের শ্রমবাজার, বর্তমানে শুধু পেশাজীবী লোক নিচ্ছে দেশটি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার ও কুয়েতে নিয়মিতভাবে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর (বিএমইটি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে কাজের উদ্দেশে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬২ জন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ৩২ লাখ আট হাজার ৮৮ জন। মধ্যপ্রাচ্যের অর্ধেকের বেশি জনশক্তি পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে ২৩ লাখ ৫৮ হাজার ৯৫ জন। কাতারে গেছে এক লাখ ৬৯ হাজার ৯৬৮ জন, কুয়েতে ৯৩ হাজার ৬৮৪ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুই লাখ এক হাজার ৭০২ জন, ওমানে তিন লাখ ৮৪ হাজার ৬১৬ জন। এছাড়া বাহরাইনে গেছে ২৩ জন। একই সময়ে ইউরোপের ২৮টি দেশে পাঠানো হয়েছে ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন শ্রমিক। গত পাঁচ বছরে ইউরোপের ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়া, মাল্টা, রোমানিয়া, যুক্তরাজ্য ও গ্রিসে সবচেয়ে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ইউরোপে গেছেন ১৬ হাজার ৭৭ জন, ২০২৩ সালে ৩০ হাজার ৪২৭ জন, ২০২২ সালে ২২ হাজার ৬০০ জন, ২০২১ সালে গেছে পাঁচ হাজার ৪৯ জন ও ২০২০ সালে এক হাজার ৫১৫ জন। কম যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় : ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে উত্তর আমেরিকার দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় গেছেন এক হাজার ৯৫৬ জন শ্রমিক। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন মাত্র ৪৬ জন। কানাডায় এক হাজার ৯১০ জন। অভিবাসনবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের শ্রমবাজার শুরু থেকেই মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর। এই নির্ভরতা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। এখানে দুটি বিষয়ের অভাব রয়েছে। আমরা ইউরোপে রপ্তানিযোগ্য শ্রমিক তৈরি করতে পারছি না। অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে শ্রমিক রপ্তানির জন্য তেমন কোনো চুক্তি নেই। এখানে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা রয়েছে। অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ইউরোপের যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি আছে সেগুলো অনেক পুরোনো। নতুন করে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হচ্ছে না। আমাদের হাইকমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শ্রমবাজার খোলার ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় কম। শ্রমবাজার খুলতে অকার্যকর গবেষণা সেল : ২০১৮ সালে নতুন ৫৩টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ শ্রমবাজার গবেষণা সেল গঠন হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সেল কার্যত অচল। অনেক বছর ধরে নতুন কোনো শ্রমবাজার তৈরি করা যাচ্ছে না। গত দেড় দশকে ৯৭টি দেশ থেকে বাড়িয়ে ১৬৮টি দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলেও এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশেই কর্মী যাচ্ছে হাতে গোনা। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় বাংলাদেশি নারী এবং পুরুষ কর্মীরা বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে প্রতি বছর জনশক্তি রপ্তানির সিংহভাগ অভিবাসী উপসাগরীয়, অন্যান্য আরব, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ১২ থেকে ১৩টি দেশেই যান। রামরুর প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ কর্মী গেছে মাত্র ১০টি দেশে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৯০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী গেছে মাত্র ছয়টি দেশে। ইউরোপে শ্রমবাজার খোলার আগে আমাদের কর্মীদের যোগ্য করে তুলতে হবে। বারবার বলছি প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের নার্সিং কোর্স চালু করা হোক। শুধু নার্স পাঠিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। -রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিক অভিবাসনখাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কর্মীদের জন্য নতুন শ্রমবাজার খুলতে না পারলে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশেই চাপ পড়ে বারবার। ফলে সেখানে কিছুদিন পরপর নিষেধাজ্ঞার কারণে শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। সেজন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও কম খরচে ইউরোপে পাঠানোর বৈধ ব্যবস্থা, এই দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ইউরোপকে গুরুত্ব দিয়ে শ্রমবাজার খোলার তাগিদ রামরুর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের যে গুটিকয়েক দেশে অভিবাসন হচ্ছে, সেগুলোতেও সমস্যা রয়েছে। ইতালিতে জাল কাগজপত্রের কারণে এবং সার্বিয়ার আবেদন প্রক্রিয়ার সার্ভার অকেজো হওয়ায় এই দেশগুলোতে শ্রম অভিবাসন কার্যক্রম থেমে আছে। সম্প্রতি ক্রোয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ শ্রমবাজারগুলোতে স্বস্তি ফেরাতে হবে। অভিবাসী ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ইউরোপের শ্রমবাজারে গুরুত্ব দেওয়াটা এখন জরুরি। আমাদের পাশের দেশগুলো নিয়মিত উন্নত বিশ্বে লোক পাঠিয়ে অধিক রেমিট্যান্স অর্জন করছে। তাই ইউরোপে শ্রমবাজার খুলতে হবে। এতে লাভ হবে আমাদের সরকারের। রেমিট্যান্স ভালো আসবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই। রোমানিয়া ও গ্রিসে বারবার লোক পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়নি। এজন্য সরকারকে সেখানে বৈধপথে চ্যানেল খুলতে হবে। সরকারের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। হাইকমিশনকে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসবে। এক দেশে গিয়ে সেখান থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাহলে কর্মীরা অবৈধ পথে পাড়ি দেবে না। রামরুর চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, নতুন বাজার খুললে সেখানে বাংলাদেশের এবং গন্তব্য দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ব্যাপক হারে কর্মী পাঠাতে শুরু করে। ফলে সেখানে শ্রমবাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। লোকজন অন্য দেশে পালিয়ে যায়। এটা বন্ধ করতে হবে। তাহলে ইউরোপের শ্রমবাজার আকর্ষণীয় হবে। উন্নত দেশ কিংবা ইউরোপে বৈধ চ্যানেলের অভাব মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় ইউরোপে বৈধ পথে যাওয়ার চ্যানেল কম এবং যাওয়ার খরচ বেশি হওয়ায় ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। এদিকে, ইউরোপে যাওয়ার জন্য অনেক দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে না থাকায় বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হয় গমনেচ্ছুদের। ইউরোপগামী ভিসাপ্রত্যাশী ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মেহেদী হাসান আশিক বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অভিবাসন, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে যাত্রা করা নাগরিকদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের কনসু্যলেট ও দূতাবাসের কার্যক্রম না থাকায় নাগরিকদের প্রায় ভারত অভিমুখী হতে হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সময় অপচয় হচ্ছে। ভারতের ভিসা ও দূতাবাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ভারতে গিয়েও হয়রানির শিকার হতে হয়। এরপর ভিসা না হলে তো সব টাকা নষ্ট। মেহেদী হাসান আশিক বলেন, ইউরোপীয় সব কনসু্যলেট ও দূতাবাসের কার্যক্রম বাংলাদেশেই সম্পন্ন করা জরুরি। তাহলে ইউরোপের দেশগুলোতে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি যেতে পারবে এবং রেমিট্যান্স দেশে আসবে। অভিবাসী উন্নয়ন ফোরামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান সাইফুল হক বলেন, 'ইউরোপের গুটিকয়েক দেশের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর নয়। আরেকটি বিষয় হলো ইউরোপের যেসব দেশে শ্রমিক যাচ্ছে সেগুলোতে নিয়মিত মাইগ্রেশন হচ্ছে না। সেসব দেশে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। মিনিস্ট্রি এবং বিএমইটি সবাই কিন্তু অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে জানে না। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে লিগ্যাল অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে না। আমাদের দাবি, রিক্রুটিং এজেন্সি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে? অবৈধ নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এজন্য রিক্রুটমেন্টে সংস্কার করতে হবে। তবে ইউরোপে শ্রমবাজার ক্রমশ উন্নত হবে। তিনি বলেন, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলো সব সময় দক্ষ লোক চায়। তাদের চাহিদা অনুযায়ী লোক তৈরি করার মতো শ্রমিক আমাদের গড়ে ওঠেনি। এদিকে নজর দিতে হবে। রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'ইউরোপে শ্রমবাজার খোলার আগে আমাদের কর্মীদের যোগ্য করে তুলতে হবে। আমরা বারবার বলছি প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছরের নার্সিং কোর্স চালু করা হোক। শুধু নার্স পাঠিয়ে অনেক কিছু করে ফেলা সম্ভব। এজন্য আগে লোকবল তৈরি করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের কর্মীদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। তারা ইউরোপে যেমন, ক্রোয়েশিয়া কিংবা রোমানিয়ায় গেলে সেখান থেকে ইউরোপের আরও উন্নত দেশে চলে যান। ফলে শ্রমবাজারে নেগেটিভ একটা প্রভাব পড়ে। কর্মীরা ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে অবৈধ পথে যাওয়ার জন্য তৈরি কিন্তু ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করে কোনো স্কিল শিখতে রাজি নন। বিদেশ গমনেচ্ছুদের এসব বিষয়ে সচেতনতা খুবই জরুরি।'