এলজিইডিতে পদোন্নতি বঞ্চিত শতাধিক প্রকৌশলী

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে ক্ষমতাচু্যত স্বৈরচারের আস্থাভাজনরা এখনও লোভনীয় পদে বসে আছেন। বড় বড় পদ ও প্রকল্প এখনও তাদের দখলে। সম্প্রতি আরো উচ্চ পদে তাদের পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে তাদের সমর্থক প্রকৌশলীরা বড় বড় প্রকল্পের পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা উলেস্নখযোগ্য। তারা 'জয় বাংলার' শ্লোগানে বিশ্বাসী হলেও বর্তমানে সুযোগ বুঝে খোলস পাল্টে ফেলেছেন। সূত্র জানায়, ফ্যাসিবাদের দোসর কতিপয় নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা যে কোনোভাবে ম্যানেজ করে ফেলছেন। শেখ হাসিনার পতনের ৬ মাসেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তারা প্রকল্প থেকে লুটের টাকায় সব ম্যানেজ করে ফেলেন। সূত্র আরো জানান, সকল যড়যন্ত্রের নেপথ্যে কাজ করছে ফ্যাসিস্ট সরকারে মদত পুষ্ট আবেদ আলী কমিশনের মাধ্যমে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। তাদের মদদ দিচ্ছে এলজিইডিতে কর্মরত আওয়ামীপন্থি এবং স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের আমলের সুবিধাভোগী প্রকৌশলীরা। এই দালালদের বিরুদ্ধে নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পিডি নিয়োগে সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে অর্থ লেনদেনে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আমিরুল ইসলাম খানকে সদস্য সচিব করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের একটি শাখা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীই রয়েছেন ১৮ জন। তারা এলজিইডিতে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। বিশ্বস্ত আরেকটি সূত্র জানায়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর এলজিইডিতে কখনও উচ্চ আদালতের আদেশে, কখনও বা নামমাত্র পরীক্ষার আয়োজনের মধ্য দিয়ে নিয়োগ হয়েছে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। উলেস্নখ্য ২০১২ সালে যে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছিল তার বিজ্ঞপ্তি হয় ২০০৬ সালে। কিন্তু দীর্ঘ ৬ বছর পরে পিএসসি যখন নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে তখন ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যারা বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেছে তাদেরকে সুকৌশলে বিপুল টাকার বিনিময়ে আবেদ আলীর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল-যেন শুধুমাত্র ৬ বছর পূর্বে যারা আবেদন করেছে তারাই অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তারাই চাকরী পায়। ওই বছর সংস্থাটির সহকারী প্রকৌশলীর একটি পদের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩ জন পরীক্ষার্থী। সেই পরীক্ষায় ১৫৪টি শূন্য পদের বিপরীতে বৈধ আবেদন ছিলো ১ হাজার ৫১৮টি। লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩৫২ জন আর উত্তীর্ণ হন ১৬২ জন। অর্থাৎ একটি শূন্য পদের বিপরীতে ১ জন উত্তীর্ণ হয়। অন্যদিকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১২৭ জন এবং ১২৭ জনই কৃতকার্য হয়। অর্থাৎ শূন্য পদের চেয়েও কম পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। তৈরি করা হয় ৭৭৮ জনের একটি প্যানেল। পিএসসির সুপারিশ ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন এজেন্ট অর্থাৎ পুলিশ ও এনএসআই ভেরিফিকেশনে তারা আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং ছাত্র লীগের কর্মি হিসেবে প্রতিবেদন দেওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে এ পরীক্ষা থেকে যোগদান করেন ৫২ জন প্রকৌশলী। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাড়ে ৩ বছর পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট ও ২৭ ডিসেম্বর উলেস্নখিত প্যানেলের বাইরে থেকে আরও ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যেখানে নিয়ম রয়েছে পিএসসির সুপারিশের মেয়াদ হবে মাত্র ১ বছর। এছাড়া নিয়োগ দেওয়াদের মধ্য হতে যদি কোনো পদ শূন্য হয় তবে প্যানেলভুক্তদের মধ্য হতে শূন্য পদ পূরণ করা হবে। এই অনিয়মে পিএসসি এবং এলজিইডি সিন্ডিকেটের যোগসাজশের বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৬ সালের বিজ্ঞপ্তির আলোকে ২০১৩ এবং ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রাপ্তরা সিনিয়রিটি দাবি করে আসছেন ২০০৬ সাল থেকেই। কিন্তু পিএসসির সুপারিশের তারিখ ও নিয়োগের তারিখ ঠিক রেখে দাবি আদায়ে অশরা হয় একের পর এক মামলা। উলেস্নখ্য, নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরেই আটকে আছে এলজিইডির প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। একইভাবে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্তদের উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত করে আওয়ামী লীগ সরকার। এলজিইডি সূত্র বলছে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সিনিয়র প্রকৌশলীদের যথাসময়ে পদোন্নতি প্রদান না করায় তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১৫ সালে প্রণীত ও যথাযথ জ্যেষ্ঠতা প্রণয়ন কমিটি দ্বারা স্বাক্ষরিত জৈষ্ঠতা তালিকা অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর ৯৮ জন সহকারী প্রকৌশলীকে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী/উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে দেওয়া পদোন্নতিকে অবৈধ দাবি করে ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীদের মধ্য হতে ৩৪ জন ২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রশাসনিক ট্রাইবুনালে একটি মামলা দায়ের করে। মামলা চলাকালে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর আরও ৮৫ জনকে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী/উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হলে ৩৪ জনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর মামলার বাদীদের বিপক্ষে রায় বা খারিজ হলে ভূতাপেক্ষভাবে ২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর হতে ৮৫ জনের পদোন্নতি কার্যকর হয়। এরপর ২০১৫ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকা মেনে নিয়ে ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্তরাসহ ৭৯ জন ৬ষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি গ্রহণ করেন। তারা পদোন্নতি পেয়েই হেরে যাওয়া মামলায় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইবুনালে আপিল করে। বর্তমানে আপিল চলমান রয়েছে। এরপর থেকেই ২০১৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা একের পর এক মামলা করে এলজিইডিকে প্রায় অচল করে ফেলেছে। আটকে আছে পদোন্নতি। উলেস্নখ্য ২০১৫ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুযায়ী প্রধান প্রকৌশলীসহ অন্যান্য প্রকৌশলীদের পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। আরো জানা যায়, ২০২৪ সালে এলজিইডির প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের একটি খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগের ওয়েব সাইটে মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়। ইতোমধ্যে এর কার্যক্রম ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। মামলার কারণে তা আজ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি পরবর্তীতে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) শূন্যপদ পুরণের জন্য প্রধান প্রকৌশলী একটি পত্রের মাধ্যমে ১০১টি পদে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে আইনগত কোন বাধা আছে কি না-তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এলজিইডি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের নিকট মতামত জানতে চান। এলজিইডির তিন বিজ্ঞ আইনজীবী বিভিন্ন মামলার সাম্প্রতিক অবস্থা ও ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারী করা প্রজাপনের আলোকে ২০১০ ও ২০১১ সালে নিয়োগকৃত ১০১ জন সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী/উপজেলা প্রকৌশলীকে নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানে আইনগত কোনো বাধা নেই-মর্মে মতামত প্রদান করেন। এলজিইডির ২০১০ ও ২০১১ সালের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আলিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ের আলোকে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ প্রকৌশলী বিএনপিন্থি পরিবারের সদস্য ও সাবেক ছাত্রদল নেতা-কর্মী। ২০১৫ ও ২০২৪ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকায় তারা সিনিয়র, রাজস্ব খাতে চাকরির বয়স ১৫ বছর এবং এলজিইডিতে ৫ শ' নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে পদোন্নতি বঞ্চিত করেছেন সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সহযোগীরা। এসকল প্রকৌশলীদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে।