ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত ৩

ফুটবল খেলোয়াড় থেকে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ খুনি হানিফ আলী

তিন দিন পর মামলা দায়ের অজ্ঞাত ১৫-২০ জন আসামি

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) আঞ্চলিক নেতা হানিফ আলী ১৪ হত্যা মামলার আসামি। লেখাপড়ায় পারদর্শী না হলেও ফুটবল খেলায় তার নামডাক ছিল। নিজের গ্রামে কিংবা আশপাশের বিভিন্ন মাঠে খেলা হলেই ডাক পড়ত হানিফের। ভালো ফুটবলার হিসেবে স্থানীয়ভাবে খ্যাতি পান তিনি। এরই মধ্যে তার ওপর নজর পড়ে এলাকার দুই চরমপন্থি নেতা টিপু ও মোয়াজ্জেমের। তারা নানা প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে হানিফকে অন্ধকার জগতে যুক্ত করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে হানিফ হয়ে ওঠেন অন্ধকার জগতের দুর্ধর্ষ খুনি। শুক্রবার রাতে দুই সহযোগীসহ প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হওয়ার পর হানিফ সম্পর্কে জানতে তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে, হত্যার ঘটনার তিনদিন পর সোমবার সকালে শৈলকূপা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। নিহত হানিফের ছোট ভাই হরিণাকুন্ডুু উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি সাজেদুল ইসলাম এশা বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন বলে শৈলকূপা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান নিশ্চিত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের ছয় ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় হানিফ আলী (৫৬)। তার পিতা কৃষি কাজ করে সংসার চালাতেন। অমনযোগী আর খেলাধুলার কারণে লেখাপড়ায় খুব বেশি এগোতে পারেননি তিনি। ঝিনাইদহ থেকে শহরে হরিনাকুন্ডু উপজেলা পৌঁছালে বড় একটি একতারা মোড়। সেখান থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তা ধরে দুই থেকে তিন কিলোমিটার গিয়ে রাস্তার ডান পাশে নেমে সামান্য এগিয়ে গেলেই হানিফের বাড়ি। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হানিফের বাগিসহ গোটা গ্রামেই এক ধরনের নীরবতা। কোথাও কোনো মানুষ নেই। নিস্তব্ধ হয়ে আছে পরিবেশ। হানিফ আলী মারা যাওয়ার শোকে তার স্ত্রী শান্তি খাতুন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। বাড়িতে কেউ নেই। যারা আছেন, হানিফ সম্পর্কে তারাও তারা কিছু বলতে রাজি হননি। হানিফের বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপর উঠতেই এক বয়স্ক ব্যক্তির দেখা মেলে। তিনি হানিফের চাচাতো ভাই আব্দুল গনি। হানিফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ছোট থেকেই খুব শান্ত স্বভাবের ছিল হানিফ। এভাবে যে অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়বে আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। তবে জেল খেটে সরকারের ক্ষমা পেয়ে বেরিয়ে ভালো হয়ে গিয়েছিল। তাদের সঙ্গে আর চলাফেরা করত না। সে কৃষিকাজ ও মাছ চাষ করে সংসার চালাত। কে বা কারা, তাকে কি কারণে তাকে হত্যা করেছে জানি না।' হানিফের বড় ভাবি সুজাতারা, 'পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পাশের রিষখালী গ্রামের টিপু ও ভায়না গ্রামের মোয়াজ্জেম আমাদের বাড়িতে হানিফকে ফুঁসলাতে থাকে তাদের দলে যোগ দিতে। রাজি না হলে একদিন ওরা হানিফের বাড়ির বাইরে একটি মাচার নিচে কাফনের টুকরা কাপড় ও সাবান রেখে যায়। এরপর কথা না শুনলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিছুদিন পর টিপু ও মোয়াজ্জেম বাড়িতে এসে হানিফের হাতে একটি অস্ত্র দিয়ে বলে আজ থেকে তুমি আমাদের দলে কাজ করবে। সে দিনই হানিফ অস্ত্রটি স্থানীয় থানায় জমা দিয়ে দেয়। এ ঘটনার পরে তাকে আরও ভয় দেখায় তারা। একদিন রাতে হঠাৎ করে তারা এক ধামা মুড়ি বাতসা আর একটি কোরআন শরিফ নিয়ে হাজির হয়। হানিফকে কোরআন শপথ করিয়ে তাদের দলে যুক্ত করে। আর মুড়ি বাতাসা খেয়ে আনন্দ করে টিপু চলে যায়। এরপর থেকে বাঁচার জন্য হানিফ ওদের সঙ্গে কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটির জনযুদ্ধের আঞ্চলিক নেতা। তিনি আরও বলেন, 'কয়েক বছর আগে টিপুকে সন্ত্রাসীরা মেরে মাঠের মধ্যে পুঁতে রেখেছিল আর মোয়াজ্জেম ক্রসফায়ারে মারা যায়।' নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার লোকজন জানান, হানিফ ৯০ দশকে চরমপন্থি দলের সঙ্গে যুক্ত হন। জনযুদ্ধের আঞ্চলিক নেতা হিসেবে ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, কুষ্টিয়ার কিছু অংশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে তার চলার পথে কোনো বাধা রাখত না। একে একে ১৪ হত্যা মামলায় আসামি হয়ে যায়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, বোমা হামলাসহ একাধিক মামলা হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে হানিফ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর কারাভোগের পর ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্তি পায়। এর পরের বছর ২০১৭ সালে নারানকান্দি বাঁওড়ে খুনের ঘটনা ঘটে। বাঁওড় মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। পরে এই বাঁওড়ের কর্তৃত্ব নেয় হানিফ আলী। শুরু করে মাছের চাষ, নাম লেখান প্রকাশ্য রাজনীতিতে। যোগ দেন হরিণাকুন্ডু উপজেলা মৎস্যজীবী লীগে। অল্পদিনে পেয়েও যান উপজেলা শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্ব।' এছাড়া, হানিফ আলীর ছোট ভাই সাজেদুল ইসলাম এশা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট করলে সে গোটা এলাকায় প্রভাব বিস্তারে কাজ করে। তার পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গোটা এলাকায় গণসংযোগ করে। এতে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়। কুলবাড়িয়া গ্রামের আলফাজ উদ্দিন হত্যা মামলায় হানিফের ফাঁসির আদেশ হয়। আলফাজ উদ্দিনের শ্যালক শহিদুল ইসলাম জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তার দুলাভাই হত্যার স্বীকার হন। কুলবাড়িয়া গ্রামে আদালত মন্ডলের বাড়িতে রাতে বসে গল্প করছিল। এমন সময় সন্ত্রাসীরা তাকে ধরে একটু দুরে নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। এই ঘটনায় তার বোন সম্পত্তি খাতুন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। অবশ্য হানিফ আলীর ছোট ভাই, হরিনাকুন্ডুু উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান এশা দাবি করেন, তার ভাই রাজনৈতিক কারণে একাধিক মামলার আসামি হয়েছিল। সব মামলা থেকে তিনি খালাসও পেয়ে যান। একটি মামলায় সাধারণ ক্ষমায় মুক্ত হন। তিনি ছাড়া পেয়ে ৬ বছর ঢাকায় ছিলেন। তিন বছর হলো এলাকায় থাকতেন। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, 'হানিফ ছিল এলাকার ত্রাস। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য হত্যাসহ অনান্য অপরাধের মামলা রয়েছে। সে সাধারণ ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে এসে আবার অপরাধী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়।'