বন্যায় ডুবছে দেশের মধ্যাঞ্চল

প্রকাশ | ২০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ফরিদপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে পস্নাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে বিভিন্ন স্থাপনা। অবশিষ্ট চালাটি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন এক প্রান্তিক চাষি। ছবিটি শুক্রবার গদাধরডাঙ্গী এলাকা থেকে তোলা -যাযাদি
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের মধ্যাঞ্চলের আরও চারটি জেলা পস্নাবিত হতে পারে। এ নিয়ে মোট ২২টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হবে। দেশের উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে বন্যায় সবচেয়ে বেশি পস্নাবিত হয়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা। চিলমারীর একজন বাসিন্দা বসির আহমেদ বলেন, এখন চিলমারী শতভাগ এলাকা বন্যা পস্নাবিত। তিনি বলেন, 'আমি যে বাড়িতে থাকি সেটি বেশ উঁচুতে। আমার বাড়িওয়ালা বলছেন ৮৮ সালের বন্যায় এই বাড়িতে পানি ওঠেনি, কিন্তু আজ সকালে আমাদের বাড়িতে পানি উঠেছে। বাড়ির বাইরে কোমরের উপরে পানি। ডিঙ্গি নৌকায় করে এই মাত্র আমার স্ত্রীকে একটা আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে এলাম। চিলমারীর সব জায়গায় এখন পানি আর নৌকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে।' কুড়িগ্রামের মতোই দেশের মধ্যাঞ্চলের চারটি জেলা আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্যায় পস্নাবিত হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তারা বলছে, এসব জেলা হচ্ছে ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং রাজবাড়ী। বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা মো. শাহেদ কাওসার জানান, উজান থেকে পানি বিভিন্ন নদনদী দিয়ে এখন এসব এলাকা পস্নাবিত করবে। তিনি বলেন, 'উজান থেকে যে পানিটা আসছে বিশেষ করে জামালপুর, কুড়িগ্রামের তিস্তা নদী- সেখান থেকে পানিটা এখন মধ্যাঞ্চলে চলে আসছে।' যে চারটি নতুন জেলা পস্নাবিত হবে তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ফরিদপুরের। ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রোকসানা রহমান জানান, বন্যার পূর্বাভাসের পরেই তারা আশ্রয়কেন্দ্রসহ দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। রোকসানা বলেন, 'আমরা বন্যার পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই জেলার সংশ্লিষ্ট সকল অফিস মিটিং করেছি। ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া নিকটবর্তী স্কুলগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ৯২টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ত্রাণের জন্য ইতিমধ্যে উপজেলাগুলোতে শুকনা খাবার চাল পাঠানো হয়েছে। আরও যে চাহিদা রয়েছে সেটা আমরা ঢাকায় জানিয়েছি।' দেশের মোট ২২টি জেলা এখন বন্যাপস্নাবিত। তবে কত মানুষ এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত তার হিসেব এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, এ বছর বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, বিহার এবং মিয়ানমারে একই সময়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার কারণে বন্যার প্রকোপটা বেশি দেখা যাচ্ছে। এমনিতে বাংলাদেশে জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের কারণে এবং উজান থেকে নদীর পানির ঢলে বন্যা হয়। আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর: রংপুর: রংপুর বিভাগে বন্যায় ৫৪৯টি সরকারি প্রাথমিক স্কুল পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে সাতটি স্কুল ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো ১৬৭টি স্কুল। রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছেন। বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে গাইবান্ধার প্রাথমিক স্কুলগুলোর। এ জেলায় চারটি প্রাথমিক স্কুল ভবন নদীতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার একটি ও ফুলছড়ি উপজেলার তিনটি, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও রাজীবপুর, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় একটি করে স্কুল রয়েছে। জানা গেছে, বন্যায় গাইবান্ধার মোট ৯৪টি প্রাথমিক স্কুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পাঠদান বন্ধ রয়েছে ১৯০টি স্কুল। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি ৪৪টির সবকটিতে পাঠদান বন্ধ, সাদুল্যাপুরে ৬টি ক্ষতি ও একটি পাঠদান বন্ধ, সাঘাটায় ৩৬টি ক্ষতি ও একটি পাঠদান বন্ধ, ফুলছড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত ২২টি ও পাঠদান বন্ধ ৮৯টি এবং গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ক্ষতি ২১টি পাঠদান বন্ধ ২০টি রয়েছে। কুড়িগ্রামে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়া স্কুলের সংখ্যা ৭টি। পাঠদান বন্ধ আছে ২৭৫টি স্কুলে। এর মধ্যে নাগেরশ্বরীতে ৩৪টিতে পাঠদান বন্ধ ও ক্ষতির সংখ্যা একটি। ফুলবাড়িতে ক্ষতি চারটি এবং পাঠদান বন্ধ ৮টিতে। রৌমারীতে ক্ষতির সংখ্যা দুটি এবং পাঠদান বন্ধ আছে ৩৮টিতে। এ ছাড়া সদরে ৩৫টি, উলিপুরে ৫১টি, চিলমারীতে ৫৬টি, ভুরুঙ্গামারীতে ১১টি, রাজারহাটে ৬টি ও রাজীবপুরে ৩৬টিতে পাঠদান বন্ধ আছে। লালমনিরহাটে ক্ষতি হওয়া স্কুলের সংখ্যা ৪১টি। বন্ধ হয়েছে ৫৭টি স্কুল। এর মধ্যে আদিতমারীতে ক্ষতি ১২টির সবকটিতে পাঠদান বন্ধ হয়েছে। কালীগঞ্জে ক্ষতি সাতটি এবং পাঠদান বন্ধ ২০টিতে। হাতীবান্ধায় ক্ষতি ১৯টি এবং পাঠদান বন্ধ ২১টিতে। রংপুরে বন্যায় ক্ষতি হওয়া স্কুলের সংখ্যা ১৩টি। পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৮টিতে। এর মধ্যে গঙ্গাচড়া উপজেলায় ক্ষতি হওয়া সাতটিতে পাঠদান বন্ধ আছে। পীরগাছায় বন্যায় ক্ষতির সংখ্যা ছয়টি। পাঠদান বন্ধ আছে একটিতে। কাউনিয়ায় একটি স্কুলে পাঠদান বন্ধ আছে। নীলফামারীতে বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ১২টি স্কুল। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় আছে ক্ষতি পাঁচটি ও ডিমলায় সাতটি। ডিমলা উপজেলার ১৬টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ আছে। পঞ্চগড়ে সদর ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় একটি করে স্কুলে পাঠদান বন্ধ আছে। রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার জানান, বন্যার কারণে বিভাগে ৫৪৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রাখতে হয়েছে। পরিস্থিতি মনিটর করা হচ্ছে। পানি নেমে গেলে স্কুলগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করাসহ শিগগিরই শিক্ষাকার্যক্রম চালু করা হবে। শেরপুর : পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের পোড়ার দোকান এলাকায় কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে প্রবলবেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে শুক্রবার সকাল থেকেই এই সড়কে শেরপুর থেকে জামালপুর হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে ২ মিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরানো ভাঙন অংশ দিয়ে বন্যার পানি দ্রম্নতবেগে প্রবেশ করায় চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, অবিরাম বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ৫ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ১৭২টি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে, পানিবন্দি রয়েছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৫ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে। নাটোর : নাটোরের সিংড়া উপজেলায় পানির স্র্রোতের কারণে বক্তারপুর ব্রিজ ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রিজ ভাঙার কারণে উপজেলা সদরের সঙ্গে অন্তত ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করা হয় বক্তারপুর মোড়ের এই ব্রিজটি। পানি বৃদ্ধির কারণে শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ করে পানির স্র্রোতে ভেঙে পড়ে ব্রিজটি। এতে করে বক্তারপুর, গোবিন্দনগর, বারইহাটি, ডাকমন্ডপ, বামনহাটসহ অন্তত ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ব্রিজ ভেঙে দ্রম্নত পানি নামার কারণে আশপাশের গ্রামগুলো পস্নাবিত হওয়ার আশংকা করছেন এলাকাবাসী। এদিকে খবর পাওয়ার পর সিংড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো, শেরকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবিব রুবেলসহ অন্যরা ভেঙে যাওয়া ব্রিজ পরিদর্শন করেছেন। রাণীনগর (নওগাঁ) : নওগাঁর রাণীনগরের সেই নান্দাইবাড়ি-মালঞ্চি বেড়ি বাঁধ ভেঙে গেছে। শুক্রবার ভোর রাতে এই বেড়ি বাঁধটি ভেঙে যায়। এতে করে ওই এলাকার ৩টি গ্রাম পস্নাবিত হওয়ায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে নদীতে পানির গতিবেগ কম থাকায় ক্ষতি কম হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উত্তরের উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে নদী ফুঁসে ওঠে। এতে রাণীনগর উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া নওগাঁর ছোট যমুনা নদীর নান্দাই বাড়ি-মালঞ্চি বেড়ি বাঁধের কয়েক জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এলাকাবাসীকে নিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেন। অবশেষে নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির চাপে শুক্রবার ভোর রাতে নান্দাই বাড়ি মাদ্রাসার দক্ষিণে প্রায় ৩০ ফিট বাঁধ ভেঙে যায়। এতে ওই এলাকার নান্দাই বাড়ি, মালঞ্চি, কৃষ্ণপুর এলাকা পস্নাবিত হয়। ওই তিন গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। খবর পেয়ে সকালে নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা, রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছেন। চিলমারী (কুড়িগ্রাম) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে চিলমারী-পার্বতীপুর রেলপথ ধসে গেছে। এতে চিলমারী থেকে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রমনা স্টেশনের উত্তর-পশ্চিম অংশের দুই জায়গায় ধস দেখা দিয়েছে। এতে রেলপথের মাটি সরে গিয়ে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। চিলমারী সদরের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। চিলমারীর শতভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে আছে। এদিকে সড়ক পথেও সারাদেশের সঙ্গে চিলমারীর বাস যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলার বিভিন্ন সড়ক, কেসি রোডে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে আছে। বৃহস্পতিবার সকালেই উপজেলা পরিষদ, থানা, স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স, এমনকি চিলমারী খাদ্য গুদাম ও পলস্নী বিদু্যতায়ন বোর্ডের সাব-স্টেশনে পানি প্রবেশের উপক্রম হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় উপজেলার বেশির ভাগ এলাকায় বিদু্যৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ পরিচালনা রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল হক।