দুদকের ৭০ ভাগ মামলার আসামি 'চুনোপুঁটিরা'

সেমিনারে দুদক চেয়ারম্যানের তথ্য

প্রকাশ | ২১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে 'দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা' শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তৃতা করেন -যাযাদি
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, কোনো অভিযোগে কিংবা মামলায় দুদক যে তদন্ত করছে, তার মধ্যে অধিকাংশই চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে। এর সংখ্যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। তাই অনেকে প্রশ্ন করেন, তারা কি শুধু চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছেন। আসলে ছোট গাছ উপড়ে ফেলা যত সহজ বড় গাছ উপড়ানো তত কঠিন। তাই বলে যে তারা বড় গাছ ধরছেন না, তা নয়। তারা ধরছেন। চুনোপুঁটিও ধরবেন। বড় মাছও ধরবেন। 'দুর্নীতি দমনে আইনজীবী ও বিচার বিভাগের ভূমিকা' শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ' কর্তৃক আয়োজিত ওই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু। সেমিনারে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, 'আসলে বৈপস্নবিকভাবে কিংবা \হহুট করে সবকিছু করা সম্ভব হবে না। আমরা আস্তে আস্তে ধরব। চুনোপুঁটি ধরেছি, বড় মাছও ধরা হবে। ইন ওয়ান গোয়িং ওয়ান জাম্প।' তিনি বলেন, 'আমরা এমন কিছু করতে চাই না। আমরা হাত দিলে হাত নিয়ে আসতে চাই না। হাত পুড়ে যাক, আমরা সবাই চলে যাই, তাও ভালো। যদি হাত দিই তো দেবই। যদি না পারি তাহলে দেব না। এটাই আমাদের কমিশনের ফিলোসফি।' মানি লন্ডারিং মামলা প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'মানি লন্ডারিং ইসু্যটা আমাদেরই। মানি লন্ডারিং আইন সংস্কার করে শুধু ঘুষ আর দুর্নীতির বিষয়গুলো কমিশন দেখছে। এ সংক্রান্ত ২০০ মামলা তদন্ত করছে কমিশন। এর মধ্যে ২২টি মামলার ২২টিতেই শাস্তি হয়েছে। অর্থাৎ শতভাগ শাস্তি হয়েছে। ঘুষ থেকে উৎসরিত অর্থ যদি লন্ডারিং হয়, তাহলে আমরা আছি। বাকিগুলো সিআইডি, বাংলাদেশ কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেখছে। তবে দুদকের ওপর অনেকেরই মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত নিয়ে প্রত্যাশা বেশি। সেটা ভালো।' 'আমরা এসব নিয়ে তিনটি রিসার্চ করছি। আমাদের ফিলোসফি রয়েছে। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। দুর্নীতির কারণে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তারা কিন্তু সব অফিস-আদালতেই দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন।' ইকবাল মাহমুদ বলেন, সমাজে দুই পেশাজীবী শ্রেণির গুরুত্ব অনেক বেশি। ডাক্তার শ্রেণি সরাসরি মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে থাকেন। কিন্তু আইনজীবীদের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্ব ও গুরুত্ব বেশি। কারণ তারা জীবন, সম্পত্তি ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষাতেও কাজ করে থাকেন। দুদকের মামলায় ভালো আইনজীবী নিতে চান। এটা নিয়ে আইনজীবীদের পরামর্শ নেয়া হবে। দুদকের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'দুদক কিন্তু হুট করে আসেনি। আমরা যারা দুদকে কাজ করি তারাও এ সমাজেরই মানুষ। এ সমাজেরই অংশ। সুতরাং আমরা মুরুদ্দার নই। সমাজের অন্যান্য জায়গায় যা হয়, তা আমাদের এখানে যে হয় না, তা নয়। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। সে দায় আমাদেরই। আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তাও কম। একটা প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন ডেপুটি পরিচালক কিংবা সহকারী পরিচালক যখন সচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। তখন সরকারি কর্মকর্তাকে ধরতে সরকারের অনুমতি লাগে না।' তিনি বলেন, ১০ থেকে ১৫ জন সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। অন্য এক দলের ১৫ জন, আরেক দলের ১২ জন। আরেক দলের ব্যবসা সংক্রান্ত তদন্ত ২৫ জন, ঊর্ধ্বতন আমলা সচিব থেকে শুরু করে ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যন্ত ১৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। ইকবাল মাহমুদ বলেন, 'আসলে সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়, মূল্যবোধসম্পন্ন বাচ্চা তৈরি করতে হবে। আমরা যদি একটা জেনারেশনকে বদলে দেয়ার যুদ্ধে সফল হতে পারি, তাহলে তারাই হবে আমাদের অ্যাসেড।' সেমিনারে ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম বলেন, সামাজিক মূল্যবোধ না থাকলে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়। আর শুধু দুদককে দিয়ে নয়, সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত ধর্ষণ হচ্ছে, যা অশনিসংকেত। দুদককে অনুরোধ করেছেন, দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা শুরু করতে হবে স্কুল থেকে। পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ সমাজে নৈতিকতা ফেরানো না গেলে, শুধু আইন করে দুর্নীতি দমন করা যাবে না। সেমিনারে আবদুল মতিন খসরু বলেন, দুর্নীতিবাজদের সাজা নিশ্চিত করলে দুর্নীতির মানসিকতাসম্পন্নরা ভয় পাবেন। তবে দুর্নীতির মামলায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। রয়েছে দক্ষ আইনজীবীর অভাব। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকার সহযোগিতা করছে। তবে তিনি বলেন, দুদকের দুর্নীতির মামলায় আইনজীবীকে যে টাকা দেয়া হয়, তা নামমাত্র। এটা বাড়াতে হবে। আর একা দুদক দিয়ে হবে না, দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ'-এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। 'সরল বিশ্বাস' নিয়ে মন্তব্য নয় এদিকে 'সরল বিশ্বাস' নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, 'ডিসি সম্মেলন শেষে আমি যে কথা বলেছি, আপনাদের কাছে তার ক্লিপ আছে। আপনারা দেখবেন আমি কোথাও দুর্নীতির শব্দ উচ্চারণ করিনি। তাই এ বিষয় নিয়ে আমি ব্যাখ্যা দিতেও প্রস্তুত নই।' শনিবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে 'দুর্নীতি দমন আইন ও বিচার বিভাগের ভূমিকা' শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম, বিচারপতি মো. নিজামুল হক ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজিম।