কোরবানির গরুর হাটে ব্যাপারীদের কান্না

প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
ভারত থেকে গরু না আসায় এবার কোরবানির পশুর হাটে গরুর দাম বাড়বে- এমন প্রচার শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের জন্য 'কাল' হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদুল আজহার কয়েক মাস আগে থেকেই গণমাধ্যমসহ খামারি পর্যায়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা ছিল ভারত থেকে গরু আসছে না, তাই এবার গরুর দাম বেশি হবে। এ প্রত্যাশায় রাজধানীর স্থায়ী ও অস্থায়ী হাটে কোরবানির পশু নিয়ে আসা গরু ব্যাপারীরা প্রথম দিকে অনেক বেশি দাম হাঁকেন। এ সময় চড়া দামে বেশকিছু গরু-ছাগল বিক্রিও করেন তারা। তবে দেশের গরুর হাটে বেপারীদের কান্না প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের খামারিরা ট্রাকে ট্রাকে যে বিপুলসংখ্যক গবাদিপশু হাটে জড়ো করেছেন, সে তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম তা তারা খেয়ালই করেননি। অথচ এর প্রভাব পড়েছে কোরবানির ঠিক আগ মুহূর্তে। ঈদুল আজহার ঠিক আগের দিনই হাটগুলোতে গরুর যোগান বেশি থাকায় চাহিদা কমে যায়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগের নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে ব্যাপারীদের গরু বিক্রি করতে হয়েছে। তাই শেষ দিনে যারা কোরবানির পশু কিনেছেন তারাই জিতেছেন। উল্টো মাথায় হাত পড়েছে অতি মুনাফার আশায় গরু ধরে রাখা ব্যাপারীদের। অনেকটা পানির দামেই শেষ দিনে তাদের গরু বিক্রি করতে হয়েছে। পাবনা থেকে ১৩টি গরু নিয়ে ৯ আগস্ট রাজধানীর মেরাদিয়া হাটে এসেছিলেন পাবনার ব্যাপারী বসিরুল মিয়া। প্রথম দিন একটি এবং পরের দিন অর্থাৎ ১০ আগস্ট আরও ৭টি গরু বিক্রি করেছেন মোটামুটি ভালো দামেই। বাকি ৫টি বড় গরু শেষ সময়ে চড়া দরে বেচবেন এমন আশায় সেগুলোর ভালো দাম উঠলেও তখন বিক্রি করেননি। তবে রোববার দুপুরের পর বড় গরুর আর তেমন ক্রেতার দেখা মেলেনি। দু'চারজন ক্রেতা দরাদরি করলেও সবাই অস্বাভাবিক কম দাম বলেছেন। প্রথমে এ দামে গরু না বেচার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে ট্রাক ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচের যোগ-বিয়োগ করে সেখান থেকে সরে আসেন। অন্তত দেড় লাখ টাকা গচ্চা দিয়ে শেষ ৫টি গরু বিক্রি করেন তিনি। এত বড় লোকসান তিনি কীভাবে পোষাবেন তা ভেবে হাটের মাঝেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বসিরুল। রোববার আফতাবনগর হাটে তার কান্নার দৃশ্য দেখছিলেন আশপাশের উৎসুক মানুষ। কারণ জানতে চাইলে আরও সজোরে কাঁদলেন তিনি। পরে বসিরুল জানান, গরু বিক্রি করে বড় ধরনের লোকসান হয়েছে তার। আগের দিন যে গরু দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, রোববার সকাল থকে সেই গরুর দাম পড়ে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকায় এসে ঠেকেছে। ঈদ শেষে এমন বড় গরু নিয়ে আরও মহাবিপাকে পড়বেন। সেই সঙ্গে বড় গরু লালন-পালনের খরচও নেহাত কম নয়। সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করে লোকসান দিয়ে হলেও গরুটি বিক্রি করে দিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। বসিরুলের আফসোস শনিবার রাতেও একাধিক ক্রেতা এসব গরুর যে দাম দিতে চেয়েছিলেন, ওই সময়ে গরুগুলো বিক্রি করলে আজ কাঁদতে হতো না। এমন ঘটনা ঘটেছে অন্যান্য পশুর হাটেও। বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার সকাল থেকেই অনেকটা কমতে থাকে গরুর দাম। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, রোববার রাতে সকল বাজারে অনেক গরুর ট্রাক এসে পৌঁছেছে। এসব গরুর ট্রাক রাস্তায় বিভিন্ন জটে আটকে ছিল। যা সবই রাতের মধ্যে ঢাকায় ঢুকেছে। আর বাজারে পর্যাপ্ত গরু থাকায় ক্রেতারা এক গরু দেখে ছুটছেন অন্য গরু দেখতে। শুক্রবার অনেকেই শুধু গরু দেখেছেন আর শনিবার কেউ দেখেছেন কেউ কিনেছেন। তবে দাম তখনও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের নাগালের মধ্যেই ছিল। যদিও ক্রেতাদের অভিযোগ ছিল বিক্রেতারা গরুর দাম কমাচ্ছে না। এরপরও শনিবার অনেক হাটেই গরু বেচাকেনা ছিল জমজমাট। রোববার সারাদিন এবং বিশেষ করে রাতে বেচাকেনাটা হয় অনেক বেশি। শেষ দিনে গরুর সঙ্কট হতে পারে কিংবা ভালো ও পছন্দের গরু না-ও পাওয়া যেতে পারে- এমন আশঙ্কায় যারা হাটে প্রবেশ করেছেন অধিকাংশই গরু কিনেই ফিরেছেন। হাট সংশ্লিষ্টরা জানান, শনিবার মাঝারি আকারের গরু বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। অথচ সেই ধরনের গরুই রোববার কেউই ৬০ হাজার টাকার বেশি দিয়ে কিনতে চাননি। তাই অনেকেই বাধ্য হয়ে গরু বেচে দিয়ে হাঁফ ছেড়েছেন। তবে কেউ কেউ ভালো দামের আশায় বুক বেঁধে থাকেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের আশাতেই থাকতে হয়েছে। কারণ শেষের দিকে ঢাকার বাইরে গরুভর্তি আটকে থাকা ট্রাকগুলো বাজারে ঢোকে। তখন বাধ্য হয়ে তাদের আরও কম দামে গরু বেচতে হয়েছে। এদিকে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে ও পশু বিক্রি করতে না পেরে রাজধানীর কোরবানির হাটগুলোতে পশু ব্যবসায়ীরা অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। যারা লোকসানের ভার বইতে না পেরে গরু নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন তাদেরও গুনতে হয়েছে চড়া ট্রাক ভাড়া। মানিকগঞ্জের বাগুটিয়া চর কাটারিপাড়া থেকে ১৩ জন চরবাসী মিলে ২৬টি গরু নিয়ে রাজধানীর মেরাদিয়া হাটে আসেন ইউনুস আলী। শনিবার পর্যন্ত ৮টি গরু বিক্রি করতে পারলেও বাকি ১৮টি গরু বিক্রি করতে পারেননি তারা। ইউনুস আলী জানান, শনিবার যে গরু ক্রেতারা ৬০ হাজার টাকা বলেছে, রোববার সেই গরুর দাম বলেছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। এই দামে গরু বিক্রি করলে লাভ তো দূরের কথা, অনেক টাকা লস হবে। এই ব্যবসায়ী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমার দুটা ছেলে-মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ে। কিছু লাভের আসায় এত দূর থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় এসেছি। কিন্তু দুটা টাকা নিয়ে যদি বাড়ি না ফিরি, তাহলে তারা ঈদের জামাতে যাবে না। বাড়ি ফিরব কেমনে?' বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কুষ্টিয়া থেকে ২২টি বড় বড় গরু নিয়ে হাটে এসেছেন তবিবুর রহমান। তিনি জানান, তার প্রতিটি গরুর দাম দুই লাখ টাকা করে। মানুষ গরুগুলো দেখতে আসে। কিন্তু দাম বলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা করে। এ কারণে তিনি একটা গরুও বিক্রি করতে পারেননি। পরে রাত ১০টার দিকে গরুগুলো ট্রাক ভর্তি করে আবারও গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি জানান, গ্রাম থেকে গরুগুলো আনতে প্রতিটির জন্য আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৫৫ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দিতে হয়েছে। এখন বাড়ি ফেরত নিতে প্রতিটি গরুর জন্য তিন হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে। সব টাকাই লস। বড় গরু হওয়ায় কেউ কিনতে চায় না। দামও বলে না।' বলতে বলতে চোখের পানি মুছতে থাকেন তবিবুর। শুধু মানিকগঞ্জের ইউনুস আলী কিংবা কুষ্টিয়ার তবিবুর রহমান নয়, তাদের মতো শত শত পশু ব্যবসায়ী কেঁদেছেন পশু বিক্রি করতে না পেরে, কেউবা ন্যায্য দাম না পেয়ে। রোববার নাগরীর ২৫টি হাটের প্রায় সব কটিতেই এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুক্র ও শনিবার দুইদিন যানজট থাকার পর রোববার ভোরে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক গরু ঢাকায় ঢোকায় গরুর দাম কমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর হাটগুলোতে শেষ সময়ে যারা এসেছেন, তারা কম দামে পশু পেয়ে ফিরছেন হাসিমুখে। সেগুনবাগিচার বাসিন্দা হাজী শাহ আলম জানান, রোববার রাতে গাবতলী হাট থেকে একলাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে যে গরু কিনেছেন, একই আকারের গরুর দাম শনিবার রাতে দেড় লাখ টাকা বলেও কিনতে পারেননি। জানা গেছে, রাতে গাবতলীতে কোরবানির পশুর হাটে অনেক ব্যবসায়ীই দাম না পেয়ে শেষ রাত পর্যন্ত হাটে অপেক্ষা করেছেন, যারা ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন কোরবানি দেন তাদের জন্য। তবে তাদের ভাগ্যেও তেমন কিছু মেলেনি। তাদেরকেও কম দামেই গরু বেচতে হয়েছে। ঈদের দিন সকালে আফতাব নগর হাটে দেখা গেছে, তখনও পশু নিয়ে বসে আছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাদের একজন দিনাজপুরের নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, 'আমি চারটা গরু নিজের খামারে লালন-পালন করে বিক্রির জন্য ঢাকায় এনেছি। কিন্তু যে দাম, এই দামে বিক্রি করলে পথে বসতে হবে। এখনও বিক্রি করতে পারিনি। গরুগুলো ঢাকায় আনতে খরচ হয়েছে। বাড়িতে ফেরত নেয়ার কোনও টাকা নেই। সেজন্যই বসে আছি, দেখি বিক্রি হয় কিনা।' বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম গাবতলী হাটের চিত্র তুলে ধরে বলেন, 'গাবতলী হাটে অনেক গরু। কিন্তু বিক্রি নেই। ব্যবসায়ীরা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এখন ট্রাকও পাচ্ছেন না। শেষ সময়ে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক গরু ঢোকায় এ অবস্থা।' এই হাটের ইজারাদার প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'এবার বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রচুর গরু রয়ে গেছে। এসব পশুর পেছনে তাদের যে পরিমাণ ব্যয় হয়েছে, তা কিছুতেই পোষাতে পারছেন না। অনেক ব্যবসায়ী চিন্তায় পড়ে গেছেন। অনেকেই খরচ পোষাতে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন।' খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গার হাটের ইজারাদার জানান, 'পশুর দাম অনেক কম। বিক্রেতারা কম দামেই বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা হতাশ। দাম না পেয়ে অনেকেই কান্না করছে।'