সময়মতো শেষ হয়নি জি কে শামীমের ২৬ প্রকল্প

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ৫৩টি প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রকল্পের চুক্তিমূল্য চার হাজার ৫৫০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা

প্রকাশ | ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
জি কে শামীম
জিকে শামীমের মালিকানাধীন জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড গণপূর্ত অধিদপ্তরের ২৬টি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা এমন প্রকল্পের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে। ২০১৯ সালে শেষ করতে হবে এমন একটি প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম নিজের পরিচয় দিতেন 'নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ?যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক' হিসেবে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চালায়র্ যাব। নিকেতনের ৫ নম্বর সড়কের ১৪৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে পাঁচ তলা ওই ভবনে অভিযান শেষে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশ' কোটি টাকার এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ পাওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর অস্ত্র, মাদক ও মুদ্রা পাচার আইনে তিনটি মামলা হয় জি কে শামীমের বিরুদ্ধে। সেসব মামলায় তিনি এখন কারাগারে আছেন। শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার হাতে থাকা বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। এসব প্রকল্পের কাজ শুরু করার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ৯ অক্টোবর গণপূর্ত অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের ৫৩টি প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। এসব প্রকল্পের চুক্তিমূল্য চার হাজার ৫৫০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এককভাবে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ করছে। বাকি ৪০টি প্রকল্পের কাজ যৌথভাবে চলছে বলে জানিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এসব প্রকল্পের ২৪টির অনুমোদন দিয়েছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আটটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। এছাড়া অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তিনটি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। বাকি ১৭টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। জিকেবির ৫৩টি প্রকল্পের মধ্যে ২০১৪ সালে একটি, ২০১৬ সালে দুটি, ২০১৭ সালে দুটি, ২০১৮ সালের তিনটি, ২০১৯ সালে ১৯টি, ২০২০ সালে ২৩টি এবং ২০২১ সালে তিনটি প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ২০১৯ সালের শেষ হওয়ার কথা এমন ১৫টি প্রকল্পের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে। ১৫ অক্টোবর একটি, ১৭ অক্টোবর দুই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি যথাক্রমে ১২, ১৫ ও ৩৫ শতাংশ। ১৩ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আগারগাঁওয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের অফিস ভবন ২০১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্মাণ কাজের চুক্তি হয়। ৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা এ বছরের ৩ জুন। নির্ধারিত সময়ের চার মাস পর এ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৯০ শতাংশ। গাজীপুর গণপূর্ত বিভাগের আওতায় ১৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচটির্ যাব কমপেস্নক্স এবং একটির্ যাব ফোর্সেস ট্রেনিং স্কুলের নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালের ২৪ মে। এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ। সচিবালয়ের নির্মাণাধীন নতুন ২০ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলা থেকে ২০ তলা পর্যন্ত পূর্ত এবং অভ্যন্তরীণ স্যানিটারি ও বৈদু্যতিক কাজের চুক্তি হয় ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এ বছরের ২৭ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। ১২০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর, তবে অগ্রগতি মাত্র ৩২ ভাগ। ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ। পাঁচ বছরে ৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। মহাখালীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডাইজেস্টিভ ডিজিজ রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল নির্মাণে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই ৪৯ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৯ শতাংশ। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের উত্তর ও দক্ষিণ বস্নকের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত নির্মাণ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা এ বছরের ২০ ফেব্রম্নয়ারি। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৫৩ শতাংশ। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ২৪ জুন শেষ হওয়ার কথা শেরে বাংলা নগরে পঙ্গু হাসপাতালে ১০০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ভবনের কাজ। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ৩৫ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বিএসটিআইয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়ের ১০ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়নের সময় নির্ধারিত ছিল এ বছরের ২৫ জুলাই। এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ২৪ শতাংশ। নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ৬৭২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল এ বছরের ৫ জুলাই। ৪১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার এ প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণে ৩১৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর। এ বছরের ২১ আগস্ট নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে আগারগাঁওয়ে এনজিও ফাউন্ডেশন ভবন নির্মাণে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর চুক্তি হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা এ বছরের ৯ অক্টোবর। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এলাকায় দুটি ১৬ তলা ভবন নির্মাণে ১৫২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চুক্তি হয় ২০১৭ সালের ১৪ জুন। এ বছরের ১৩ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ। এই সময়ে রূপপুরে আরও দুটি ১৬ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণে ১৫৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকার চুক্তি হয়। এ দুটি ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার সময়ও এক। এ দুটি ভবন নির্মাণে অগ্রগতি ৯০ ভাগ। ৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বান্দরবান জেলা হাসপাতালের ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের চুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৪ মে। এ বছরের ২৪ নভেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ। এক প্রশ্নের উত্তরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন বলেন, নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হতে পারে। "বাস্তবায়নকারী সংস্থা কাজ শেষ করার জন্য তাগাদা দেবে। কিন্তু আমি হয়তো তাদের সাইট বুঝিয়ে দিতে পারিনি। যাদের নকশা দেওয়ার কথা তারা হয়তো নকশা দিতে পারেনি। অথবা যে অথরিটির কাজ, তারা টাকা দিতে পারেনি।" প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরির ফলে ব্যয় বেড়েছে কিনা- সেই তথ্য দিতে পারেননি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। "এ ব্যাপারে পুরোপুরি বলা সম্ভব না। সে কতটুকু কাজ করেছে, কতটুকু বাকি আছে। এসব হিসাব-নিকাশের ব্যাপার আছে। তাছাড়া অনেকগুলো প্রকল্প, না জেনে বলা কঠিন।" জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. গোলাম মুস্তাফার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নেই।