অসহায় সাধারণ রোগীরা

ঢামেকে ভ্যাক থেরাপি বাণিজ্য

অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্য নিবির্ঘœ করতেই হাসপাতালের নিজস্ব ভ্যাক মেশিনে কৌশলে অকেজো করে রাখা হয়েছে। এমনকি স্বল্পমূল্যের এ মেশিন কেনার উদ্যোগও বিশেষ মহল দীঘির্দন ধরে চাপা রেখেছে

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

জাহিদ হাসান
প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ঢাকা মেডিকেলের বানর্ ইউনিটে নিবিের্ঘœ চলছে ভিএসি বা ভ্যাক থেরাপি বাণিজ্য। প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কমর্চারী এ অপতৎপরতা চালিয়ে রাতারাতি মোটা অংকের টাকা কামালেও বিনামূল্যের এ সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ রোগীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরেজমিন ঢামেকের বানর্ ইউনিটে গিয়ে একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত চার বছর ধরে (২০১৪ সাল থেকে) হাসপাতালের বরাদ্দকৃত ২টি সরকারি ভিএসি বা ভ্যাক (ভ্যাকুয়াম অ্যাসিস্টেড ক্লোজার) থেরাপি মেশিন অকেজো হয়ে আছে। ফলে বানর্ ইউনিটে রোগীদের অস্ত্রোপচারের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পরিষ্কারকারী (অটোক্লেভ মেশিন অপারেটর) কমর্চারীর ভাড়া দেয়া মেশিনে থেরাপি নিচ্ছেন রোগীরা। এতে করে সরকারি হাসপাতালে ভতির্ হয়েও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সেবা কিনতে হচ্ছে তাদের। অভিযোগ রয়েছে, কমর্চারীদের ভ্যাক থেরাপি বাণিজ্য নিবির্ঘœ করতেই হাসপাতালের নিজস্ব ভ্যাক মেশিনে কৌশলে অকেজো রাখা হয়েছে। এমনকি স্বল্পমূল্যের এ মেশিন কেনার উদ্যোগও বিশেষ মহল দীঘির্দন ধরে চাপা দিয়ে রেখেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ভ্যাক থেরাপি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আগুনে পোড়া রোগীদের শরীরের ঘা বা ক্ষত শুকানো হয়। এছাড়া প্যারালাইজড, কিডনি নষ্ট, হাড় ভাঙা বা পঙ্গু রোগী, যাদের দীঘির্দন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। এ কারণে তাদের পিঠে বা কোমরে ক্ষত তৈরি হয়, যেটিকে বেডসোর বা শয্যাক্ষত বলে। আবার ডায়াবেটিক ফুট রোগীদের কোনো ক্ষত বা ঘা (গ্যাংরিন) মারাত্মক আকার ধারণ করলে অনেক সময় পা কেটে ফেলতে হয়। তখন মেশিনটি ব্যবহার করে ক্ষতস্থান ভালো করার চিকিৎসা পদ্ধতিই হলো ভ্যাকুয়াম থেরাপি। এতে করে বেডসোর ও ডায়াবেটিক ফুট রোগীদের গভীর-অগভীর সব ধরনের ক্ষতস্থান দ্রæত ভালো করা সম্ভব হয়। ক্ষত শুকানোর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পকের্ জানতে চাইলে বানর্ ইউনিটের ক্লিনিক্যাল অ্যাসিটেন্ট, নাসর্ ও চিকিৎসকরা যায়যায়দিনকে জানান, ভ্যাকুয়াম থেরাপি একটি বাস্তবধমীর্ ক্ষত চিকিৎসা পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ক্ষত বা অপারেশন সাইট থেকে রক্ত বা তরল শোষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে বিশেষ ধরনের একটি ফোম ক্ষতস্থানে লাগানো হয়। এরপর বিশেষ ধরনের পাতলা ফিল্ম দিয়ে ক্ষতস্থান সম্পূণর্ ঢেকে (সিল করে) দেয়া হয়। সিলের ভেতর থেকে একটি পাইপ ভ্যাকুয়াম মেশিনের পাম্পে সংযুক্ত করা হয়। পাম্পের সাহায্যে ক্ষত বা পুড়ে যাওয়া স্থানের তরল পদাথর্ ও সংক্রামক উপাদানগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাইরে টেনে নিয়ে বোতলে জমা হয়। তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক রোগীর অভিযোগ আগে সরকারিভাবে এ থেরাপি দেয়া হতো। কিন্তু মেশিন নষ্টের অজুহাত দেখিয়ে গত চার বছর ধরে সরকারিভাবে থেরাপি কাযর্ক্রম বন্ধ। এ সুযোগে বানর্ ইউনিটের অটোক্লেভ মেশিন অপারেটর রমজান আলী ও পলাশ নামে চতুথর্ শ্রেণির দুই কমর্চারী নিজ উদ্যোগে মেশিন কিনে রোগীদের কাছ থেকে নগদ অথের্র বিনিময়ে থেরাপি দিয়ে থাকেন। বানর্ ইউনিটের পঞ্চম তলার গ্রিন ইউনিটের ৫১৩নং মেল ওয়াডের্র ৬ নম্বর বেডে ভতির্ আছেন গোপালঞ্জের আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, ৫ দিনের প্যাকেজে দুটি থেরাপি নিতে তার নগদ ৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পাশে বসা স্ত্রী রোকসানা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, আগে থেরাপিটি হাসপাতাল থেকে দেয়া হলেও এখন অপেশাদার ব্যক্তির কাছ থেকে এ সেবা কিনে নিতে হচ্ছে। তাছাড়া মেশিনটি প্রতি ৫ মিনিট অন্তর ১০ মিনিট সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ থাকে। ব্যক্তিগত মেশিন হওয়ায় সেটি সঠিক নিয়মে কতক্ষণ ব্যবহার করলে রোগীর জন্য উপকার হবে তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে এটি চালানোয় হাসপাতালের বিদ্যুৎ খরচ হলেও সরকার কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স পাচ্ছেন না। একই ওয়াডের্র ৫নং বেডে থেরাপিরত অবস্থায় আছেন হারুনুর রশিদ নামে আরেক রোগী। তার স্ত্রী বলেন, প্যাকেজভেদে প্রতি থেরাপির জন্য থেকে ৭ হাজার ৮ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। অথচ সব রোগীর পক্ষে এটি নিয়মিত বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। থেরাপি অপারেটরের কাছে একটা মেশিন ক্রয়ের কথা বলায় ২২ হাজার টাকা চেয়েছেন। তাছাড়া এটি লাগানো বা খুলতে কোনো চিকিৎসক, নাসর্ বা ওয়াডর্বয় কেউ সাহায্য করে না। নাম প্রকাশ না করার শতের্ কয়েকজন ক্লিনিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট বলেন, ১০০ শয্যার বানর্ ইউনিটে প্রায় ৬০০ অধিক রোগী থাকে। কম-বেশি প্রায় সব রোগীরই থেরাপি দরকার হয়। এ জন্য প্রতি ফ্লোরে ৬ থেকে ৮টা ভ্যাক মেশিনের প্রয়োজন। আর ৩ থেকে ৫ দিনব্যাপী একটি থেরাপি বাবদ একজন রোগীর কাছ থেকে যদি ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা করে নেয়। তাই কতৃর্পক্ষের উচিত, সরকারিভাবে সেবা দেয়া। মেশিন ভাড়া দেয়ার কমর্চারী রমজান আলী বলেন, তিনি সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নন। তবে দীঘির্দন ধরে কাজ করায় হাসপাতালের অটোক্লেভ মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিমিও এর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আর হাসপাতালের ২টি মাত্র ভ্যাক থেরাপি মেশিন ছিল যেগুলো সাভির্ংয়ের জন্য কোনো ম্যানপাওয়ার না থাকায় অকেজো হয়ে আছে। এ কারণে নিজে দশ-বারোটি মেশিন কিনে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। প্রয়োজনে গরিব রোগীদের বিনামূল্যে সেবা দেন বলে জানান তিনি। বিষয়টি সম্পকের্ বানর্ ইউনিটের আবাসিক সাজর্ন ডা. পাথর্ শঙ্কর পাল যায়যায়দিনকে বলেন, তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে হাসপাতাল থেকে এ সেবা দেয়া হতো কিনা সেটা জানেন না। তবে সরকারিভাবে এটি দেয়া হয় না। আর এ সেবার জন্য বানর্ ইউনিটে দুটি হাইকারবোরিক অক্সিজেন থেরাপি মেশিন আছে। যাদের বয়স বেশি ও হাটের্ সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা থাকে তাদের এবং ডায়াবেটিস রোগীদের অপারেশনের বিকল্প হিসেবে এটি দেয়া হয়। হাসপাতালে নেই বলেই ব্যক্তিগতভাবে একজন সেবাটি দিচ্ছে। তবে রোগীদের অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি উদ্যোগে থেরাপি সেবা না থাকার বিষয়টি সম্পকের্ জানতে চাইলে বানর্ ইউনিটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেন যায়যায়দিনেক বলেন, ভ্যাকুয়াম থেরাপিকে সংক্ষেপে ভ্যাক বলা হয়। হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাটি দেয়া হচ্ছে না বিষয়টি সত্য তবে এখন নতুন করে মেশিন কেনার জন্য বাজেট দেয়াও সম্ভব না। পাশেই জাতীয় বানর্ অ্যান্ড প্লাস্টিক সাজাির্র ইনস্টিটিউট হচ্ছে। সেখানে সরকারিভাবে থেরাপি চালু করা হবে। তখন এ ইউনিটের রোগীরাও পাবেন।