রোহিঙ্গা সহায়তায় এনজিও ব্যয়ে স্বচ্ছতার অভাব দেখছে টিআইবি

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান -যাযাদি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর ব্যয়ের হিসাবে 'স্বচ্ছতার অভাব' দেখতে পাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)। বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে 'বলপূর্ব বাস্তুচু্যত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ ও তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, 'বেসরকারি অংশীজনদের তথ্য প্রদানে অনীহা আছে। তারা নিজেদের স্বচ্ছ বললেও তারা সেটা করছে না। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলোর দেয়া কর্মসূচি ব্যয়ের মধ্যে তাদের অনুদানে পরিচালিত এনজিওগুলোর পরিচালন ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত।' টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউনিসেফের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে কম, তাদের মোট ব্যয়ের ৩ শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ টাকাই তারা কর্মসূচিতে ব্যয় করে। মিয়ানমান থেকে পালিয়ে আসার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা করতে আসা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর ব্যয়ে অস্বাভাবিক অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে টিআইবি। জাতিসংঘের অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থাগুলো অন্যদের স্বচ্ছ হতে বললেও নিজেরাই রয়ে গেছে অস্বচ্ছতার মধ্যে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদারের কাছে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, ফলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা নিয়ে ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার কাজে থাকা এনজিওগুলো নিজেদের পরিচালন ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করতে চায় না। যে হিসাব তারা দেয়, প্রকৃত ব্যয় তার চেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাতিসংঘের যে সংস্থাগুলো কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রে কাজ করছে, তাদের মধ্যে ইউএন উইম্যানের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে বেশি। যে টাকা তারা সেখানে খরচ করছে, তার ৩২ দশমিক ৬ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে পরিচালন বাবদ। বাকি ৬৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ মানবিক সহায়তা কর্মসূচিতে খরচ করছে তারা। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউনিসেফের পরিচালন ব্যয় সবচেয়ে কম, তাদের মোট ব্যয়ের ৩ শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশ টাকাই তারা কর্মসূচিতে ব্যয় করে। টিআইবি বলছে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট আখ্যা দিয়ে এর মোকাবেলায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি এনজিও এ কাজে সম্পূক্ত রয়েছে। কিন্তু কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের একটি বড় অংশ বিলাসিতায় ব্যয় করছে বলে ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে জাতিসংঘের অনুদানে পরিচালিত কর্মসূচির পরিচালন ব্যয়ের যে হিসাব সংস্থাগুলো দিয়েছে, তার প্রকৃত পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরও বেশি। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কমপক্ষে ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রোহিঙ্গাদের পেছনে। পরোক্ষ ব্যয় আরও অনেক বেশি। এ ছাড়া রয়েছে আর্থ-সামাজিক, পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংকট। তিনি আরো বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরেও যারা মিয়ানমারে এই নিধন প্রতিকারের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত। এখানে অনেকের স্বার্থ রয়েছে। আমরা সবসময় নিজেদের সমস্যা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু এবারের এই সঙ্কট আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। জাতিসংঘের দপ্তরের কাছে প্রতিবেদন ছিল। তাদের স্পন্সর করা প্রতিবেদনে এই জাতিগত নিধন যে হতে পারে এবং প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আর এখন স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকারীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে মন্তব্য করেন টিআইবির এ শীর্ষ কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রয়োজনের বিপরীতে সম্পূর্ণ অর্থ পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে মানবিক সহায়তার তহবিলে বাংলাদেশ আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছে। প্রতিবেদনে টিআইবি বলেছে, রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর বেশির ভাগেই প্রমাণ মিলেছে। এনজিও বু্যরোর কর্মকর্তারা প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা এবং অনুমোদনে নিয়মবহির্ভূত অর্থ ও উপঢৌকন নিচ্ছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে উপজেলার চিত্র প্রায় একই রকম। প্রকল্প ছাড়পত্র নিতে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা কখনও ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক ও ইউএনও কার্যালয়ের সংস্কার এবং একটি স্থানীয় অটিস্টিক বিদ্যালয়ে সহযোগিতার নামে সংস্থাগুলোকে টাকা দিতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। আবার ক্যাম্পে কাজ করার ক্ষেত্রে অনুমোদন/ছাড়পত্র পেতে সিআইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক নিয়মবহির্ভূত টাকা ও অনৈতিক সুবিধা, যেমন বিমানের টিকিট, আত্মীয়-স্বজনের কেউ বেড়াতে এলে গাড়ি ও হোটেল সুবিধা নেয়া অভিযোগ রয়েছে। ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ভিন্ন ভিন্ন যাচাই ব্যবস্থার কারণে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ সময়ক্ষেপণের অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক নিয়মিত ও বিশেষ ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ত্রাণের মালবাহী গাড়িপ্রতি ৩০০০ টাকা ঘুষ নেয়া এবং ৫ থেকে ১৫ দিন সময় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। যেসব সংস্থা ঘুষ দেয় তাদের ক্ষেত্রে মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে বালাই নেই। এক কথায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে 'অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ঝুঁকি' সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে টিআইবি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ে সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। জনবল ঘাটতির কারণে এনজিওগুলোর কার্যক্রমে তদারকি ব্যাহত হচ্ছে। মানব পাচারের ক্ষেত্রে দালালদের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে বলেও লক্ষ্য করেছে টিআইবি। এসব সংকট উত্তরণে সমন্বয়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, প্রত্যাবাসনে ১৩টি প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) শাহজাদা এম আকরাম। এ ছাড়া প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মো. শাহ্‌নূর রহমান, নাজমুল হুদা মিনা, সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মহিউদ্দীন উপস্থিত ছিলেন।