বিএসএমএমইউর বৈকালিক সেবা

এক বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি টিকিট বৃদ্ধির প্রতিশ্রম্নতি

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈকালিক সেবায় চিকিৎসা প্রত্যাশীদের উপচে পড়া ভিড় হলেও সময় স্বল্পতা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনীহায় চাহিদা অনুযায়ী গুণগত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। এমনকি দিন দিন রোগীর সারি দীর্ঘতর হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সময় ও টিকিট সংখ্যা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েও তার বাস্তবায়ন করেনি। এমন পরিস্থিতিতে জনসেবামূলক এ কার্যক্রমকে 'কাগুজে বিশেষজ্ঞ সেবা' বলে মন্তব্য করছেন অনেকেই। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে বিএসএমএমইউ'তে চালু হওয়া এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পেতে প্রতিদিন সকাল থেকে সহস্রাধিক রোগীর ভিড় হয়। আর রোগী বেশি হওয়ায় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় টিকিট বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও আদতে তার বাস্তবায়ন হয়নি। এমন প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সুলভমূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা নিতে এসে টিকিট সংকট ও রোগী দেখতে চিকিৎসকরা কম সময় দেওয়ায় আশানুরূপ সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। রোগীরা অভিযোগ করছেন, অনেকে সারাদিন অপেক্ষা করেও টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক লোক হাসপাতালের কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের হাত করে ভোগান্তি ছাড়াই দুপুর ১২টার মধ্যেই বৈকালিক সেবার টিকিট পাচ্ছেন। এছাড়া ২৪টা বিভাগে প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এই স্বল্প সময়ে একজন অধ্যাপক বা সহযোগী, সহকারী অধ্যাপকের সঙ্গে দুই-তিনজন রেসিডেন্ট (আবাসিক চিকিৎসক) রোগী দেখলেও মেডিসিন, নিউরোমেডিসিন, নিউরোলজি, লিভার, রিউমাটোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি (ডায়াবেটিস ও হরমোন), গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি'র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ফলোআপসহ ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি রোগী দেখেন না। যেটি ১নং বহির্বিভাগে বৈকালিক সেবার জন্য টাঙ্গানো নির্ধারিত বোর্ডে নিয়মিত লিখে দেওয়া হয়। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক রোগী এসেও সেবা বঞ্চিত হন। এর উপর আবার হাসপাতাল স্টাফদের কারসাজি ও নিরাপত্তা কর্মীদের টিকিট বাণিজ্য তো রয়েছেই। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এমন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে যায়যায়দিনকে বলেন, ১০ জনের বেশি রোগী না দেখার কারণ হিসেবে অধ্যাপকদের দাবি শুরু থেকেই তাদের প্রতি এমন নির্দেশনা ছিল। যদিও তার কোনো প্রমাণপত্র হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। ফলে অধ্যাপক চিকিৎসকদের অনেক বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এছাড়া স্পেশালাইজড সার্ভিসের টিকিট সীমিত হওয়ায় মেডিসিন, নিউরোমেডিসিন, রিউমাটোলজি ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগে হাসপাতাল স্টাফদের জন্য কোনো টোকেন দেয়া হয় না। যেটি বৈকালিক সার্ভিসের তত্ত্বাবধায়ন কর্মকর্তা ও সেকশন অফিসার, পরিচালক (হাসপাতাল) মো. মাসুদ আল হাসানের অফিস কক্ষের দরজায় নোটিশে লিখে দেয়া হয়েছে। এরপরও প্রতিদিন অসংখ্য স্টাফ নিজে ও আত্মীয়দের দেখানোর জন্য ধরনা দেন। আর বিএসএমএমইউতে ৫ হাজার স্টাফের মধ্যে কে বা কারা এমনটা করছেন সেটা বের করা কঠিন। কারণ দেখভালের জন্য হাসপাতাল পরিচালক শাখা থেকে মাত্র ২ জন জনবলকে দায়িত্ব দেয়া হলেও তাদের বসার জন্য কোনো জায়গা দেওয়া হয়নি। তাই জালিয়াতি ধরাও অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিএসএমএমইউ'র পরিচালক পর্যায়ের একজন চিকিৎসক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এই সেবা চালু করছিলেন। কিন্তু তখন থেকেই প্রায় প্রতিটা বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক চিকিৎসকরা এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখাননি। কারণ বৈকালিক সেবায় একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ ১০ জন রোগী দেখে ১০০ টাকা হারে এক হাজার টাকা সম্মানী পান। সেই একই সময় তিনি যদি প্রাইভেট চেম্বারে প্র্যাক্টিস করেন (রোগী দেখেন) তাহলে এর চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বৈকালিক সেবাদানে তাদের মনোযোগ ও আগ্রহ কম থাকে। যার প্রভাব পড়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা পাবার আশায় বঞ্চিত হওয়া রোগীদের উপর। বিএসএমএমইউ'র অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. নাজমুল করিম মানিক যায়যায়দিনকে বলেন, বৈকালিক সেবায় ২৪টি বিভাগে মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানোর সুযোগ থাকায় কমবেশি সবাই আসেন। তবে কয়েকজন অধ্যাপক কম রোগী দেখেন। এর বাইরে চিকিৎসকরা অন্যান্য বিভাগগুলোতে দীর্ঘ সময় দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে চারশ'র মতো রোগী দেখছেন। বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানরা দুপুর আড়াইটা থেকে নতুন-পুরাতন মিলে ৩০ থেকে ৮০ জনের মতো রোগী দেখেন। এর মধ্যে রিউম্যাটোলজি ও চর্মরোগের মতো বিভাগে রোগীদের স্বল্প সময়েই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। ফলে নিউরোলজি বা হেপাটলোজির রোগীদের বেশি সময় দিতে কোনো সমস্যা হয় না। আর ভবিষ্যতে সুযোগ-সুবিধা বাড়লে বৈকালিক সেবার কলেবরও বাড়বে। তিনি বলেন, টিকিট কালোবাজারির বিষয়টা ছোট-খাটো ব্যাপার, কারণ সারাদেশেই এমন সমস্যা আছে। নজরদারি করাটা কঠিন। নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। কেউ ধরা পড়লে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। কোয়ালিটি নিশ্চিতের ব্যাপারে তিনি বলেন, একজন রোগী কয়েকবার করে ফলোআপে আসায় সঠিক সেবাটাই পেয়ে থাকেন। কেননা প্রাইভেট মেডিকেলে দেখাতে বেগ পেতে হলেও এখানে সহজে সেবা পাচ্ছেন। এমনকি রুটিনমাফিক অধ্যাপক চেয়ারম্যান সবাই বসছেন। একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এটি পরিচালিত হচ্ছে। আগামীতে পরিধি আরো বাড়বে। এমনকি সার্জারি ও মেডিসিনের ২৪টি বিভাগে জানুয়ারিতে ১৫ হাজার ৫৮৯ জন, ফেব্রম্নয়ারিতে ১৪ হাজার ৬৪২, মার্চে ১৬ হাজার ৬৭২, এপ্রিলে ১৫ হাজার ৯৩৯, মে'তে ১০ হাজার ৬১৩, জুনে ১১ হাজার ৮৫৩, জুলাইয়ে ১৭ হাজার ও আগস্টে ১১ হাজার ৬১৩ জন রোগী সেবা নিয়েছেন।