হাসপাতালে বাড়ছে শীতকালীন রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

জাহিদ হাসান
রাজধানীর মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে শিশু রোগীর ভিড় -যাযাদি
শীত এখনো জেঁকে না বসলেও নবজাতক ও শিশুদের ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। গত দুই মাসের তুলনায় বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে ৭০ ভাগ শিশুই সাধারণ সর্দি, কাশি বা সিজনাল ফ্লু জাতীয় রোগ-ব্যাধি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। সরেজমিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে চিকিৎসাধীন অধিকাংশ শিশুই শীতজনিত বিভিন্ন মৌসুমি রোগ যেমন, কমনকোল্ড, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে। শিশুরোগ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি এই দুই মাস দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে নবজাতক ও শিশুরা পরিবেশের সঙ্গে সহজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। এতে করে তারা বেশি পরিমাণে শীতকালীন রোগ-ব্যাধি যেমন : সর্দি-কাশি-হাঁচি ও নিঃশ্বাসে কষ্টজনিত সমস্যা ছাড়াও ভাইরাস জ্বর, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, ফুসফুসের সংক্রমণের মতো সমস্যায় ভুগে থাকে। এ ধারাবাহিকতায় ঢাকা ুশিশু হাসপাতালের পালমোনারি ডিজিজ বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে অধিকাংশ শিশুই ঠান্ডাজনিত রোগের কারণে ভর্তি রয়েছে। ওই ওয়ার্ডের চিকিসকরা বলছেন, শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাসপাতালের বহিঃ ও আন্তঃবিভাগে সর্দি-কাশি, টনসিল বা গলা ব্যথা, নাক-কানের সমস্যা, এলার্জি, ভাইরাস জ্বর, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তাদের ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শাফি আহম্মেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, সাধারণত শীত ঋতুতে শিশুদের কমনকোল্ড বা সর্দি-কাশি, ভাইরাল ফিভার বা ভাইরাস জ্বর, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিউলাইটিস ছাড়াও কোল্ড ডায়রিয়া, রোটাভাইরাল ডায়রিয়া ও চর্মরোগ দেখা দেয়। মূলত এ সময়টাতে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ধুলা-বালুযুক্ত পরিবেশ ও কুয়াশার কারণে এসব রোগ-ব্যাধি হয়। বর্তমানে ৬৫০ শয্যার হাসপাতালের সব বেড রোগী দিয়ে পূর্ণ। এ ছাড়া পিআইসিইউ, এনআইসিউ, কার্ডিয়াক আইসিইউ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট ডেভেলপ বা সিসিআইডি, হাই ডিফেসিয়েন্সি ইউনিট বা এইচডিইউ বেডগুলোও পূর্ণ রয়েছে। গত মঙ্গলবার বহিঃবিভাগে ৮০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় বহিঃবিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৭৫০ থেকে ৮০০ জনের মতো রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। যাদের অধিকাংশই ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধির স্বীকার হয়ে আসছে। হাসপাতালটির অ্যাজমা সেন্টারের প্রধান ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল যায়যায়দিনকে বলেন, শীতকালে শিশুদের পরিচিত সমস্যা হচ্ছে অ্যালার্জি ও অ্যাজমা। ফলে সর্দি-হাঁচি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়ে বুকে চাপ সৃষ্টি করে ও আওয়াজ হয়। এছাড়া অনেকের সাইনোসাইটিস সমস্যায় মাথা ধরা, সর্দি-কাশির প্রবণতা, কাশতে কাশতে বমি ও জ্বর হয়ে থাকে। ভাইরাসের কারণে আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়ার কারণে লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক সংক্রমণ দেখা দেয়। ফুসফুস সংক্রমণে জ্বর, কাশি, কফ, শরীর ব্যথা ও বমি বমি ভাব ও ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়। চলতি বছর শীত শুরু হওয়ায় গত দুই মাসের চেয়ে কয়েকগুণ রোগী বেড়ে গেছে। গত ২৮ নভেম্বর ২৪ জন, ২৯ তারিখে ৩০ জন, ৩০ তারিখে ২৬ জনসহ নভেম্বর মাসে ৪৫০ জন শিশু শুধু অ্যাজমা সেন্টারেই এসেছে। এ ছাড়া ১ ডিসেম্বর রোববার ২০, ২ ডিসেম্বর সোমবার ৫০, ৩ তারিখে মঙ্গলবার ৫৫ ও ৪ তারিখে ৫৯ জন শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। গত এক সপ্তাহে দিনে ৩০ জনকে স্পাইরোমেট্রি ডায়াগনোসিস করানো হয়েছে। মাতুয়াইল শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের (আইসিএমএইচ) শিশু বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মাহবুব আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, শুধু ঢাকার মধ্যে নয় দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকেও নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য শীতকালীন রোগ-ব্যাধি নিয়ে এই হাসপাতালে রোগীরা আসছে। এখানে বহিঃ ও আন্তঃবিভাগে অক্টোবর মাসে ২ হাজার ১৪৭ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। নভেম্বরে আবহওয়ার তারতম্য ও শীতের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ায় এ সংখ্যা বেড়ে ২ হাজার ৪৭০ জনে পৌঁছায়। যাদের মধ্যে অধিকাংশই শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ডায়রিয়া, সেপ্টিসেমিয়া, খিঁচুনি ও টাইফয়েডে আক্রান্ত ছিল। তাছাড়া অক্টোবরে আন্তঃবিভাগে ভর্তি হওয়া ৩০৯ জনের মধ্যে ৯০ জন শ্বাসকষ্ট জনিত, ৩৯ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি ছিল, যা মোট রোগীর এক তৃতীয়াংশ। একইভাবে নভেম্বর মাসে আন্তঃভিভাগে ভর্তি হওয়া ৩৪৮ জনের মধ্যে ১৫৩ জন শ্বাসকষ্ট, ৫৮ জন শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল, যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোট রোগীর অর্ধেক। মোহাম্মদপুর মা শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, শীত ঋতুতে বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেশি হওয়ায় তাদের হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিউলাইটিস, যক্ষ্ণা ও অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চারা শীতকালীন ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়েও হাসপাতালে আসছে। তবে শিশুদের চিকিৎসায় এখানে পর্যাপ্ত শয্যা, রোগীর ওজন, উচ্চতা নির্ণয়ের ব্যবস্থা, ন্যাসোফ্যারিনজিয়াল অ্যাসপিরেটস সাকশন, রক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরিমাপ যন্ত্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার, প্রায় সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। শিশুদের শীতজনিত রোগ থেকে রক্ষা পেতে কী কী করণীয় এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শাফি আহম্মেদ যায়যায়দিনকে বলেন, শীত থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের কুসুম গরম পানিতে গোসল, গরম কাপড় পরিধান, বিশুদ্ধ পানি পান, রাস্তার খাবার, বাসি-পচা ঠান্ডা খাবার ও এলার্জিজনিত খাদ্য খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে। এ ছাড়া বাইরের পরিবেশ বিশেষ করে ঠান্ডা বাতাস ও কুয়াশার সংস্পর্শ থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে।