হকারমুক্ত ফুটপাত, তবুও বেদখল

গ্যারেজ, পার্কিং, ক্লাব, দলীয় অফিস গড়ে উঠছে সেখানে বেঁচে থাকার তাগিদে চুরি-ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছেন হকাররা ভ্যান নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানোয় বাড়ছে ভোগান্তি-যানজট থেমে নেই রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের চাঁদাবাজি

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দফায় দফায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে নগরীর ব্যস্ত সড়কসংলগ্ন অধিকাংশ ফুটপাত থেকে কয়েক লাখ হকার উচ্ছেদ করলেও এর বেশির ভাগই এখনো পথচারীর চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠেনি। বরং হকারদের তুলে দেওয়ার পর নগরীর বিভিন্ন রাস্তাসংলগ্ন ফুটপাত দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রিকশার গ্যারেজ, ক্লাব, নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা অফিসের স্থায়ী পার্কিং গড়ে তোলায় তা এখন আরও পাকাপোক্তভাবে বেদখল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ফুটপাতের সঙ্গে রাস্তার একাংশ দখল করে রাজনৈতিক কার্যালয় নির্মাণ করায় ফুটপাত দখলমুক্ত করার মূল টার্গেট পুরোপুরিই ভেস্তে গেছে। অথচ ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের পর বেকার হয়ে যাওয়া অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ছিঁচকে চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন ক্রাইম জোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, সম্প্রতি চুরি-ছিনতাইসহ ছোটোখাটো অপরাধে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকে বেকার হকার। তারা পেটের তাগিদে এ ধরনের অপকর্মে জড়িয়েছে বলে তারা নিঃসংকোচে স্বীকারও করছে। দ্রম্নত তাদের নূ্যনতম কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। ফুটপাত হকারমুক্ত হওয়ার পর নতুন করে সেখানে রিকশার গ্যারেজ, গাড়ি পার্কিং, রাজনৈতিক কার্যালয় গড়ে ওঠার বিষয়টিও তারা স্বীকার করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার একাংশ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে ফুটপাত দখল করে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্থাপনা, গাড়ি পার্কিং, রিকশার গ্যারেজ এবং রাজনৈতিক কার্যালয় গড়ে উঠেছে। সেখানকার বাই লেনের পাশাপাশি বেশকিছু প্রধান সড়কে নতুন করে স্থায়ী রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ গড়ে তোলা হয়েছে। ৫ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়সহ দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের একাধিক কার্যালয় ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে নির্মিত। বেশকিছু ব্যস্ত সড়কসংলগ্ন ফুটপাতে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ক্লাবঘর ও বস্তি গড়ে তুলেছে। ফলে ওইসব সড়ক ব্যবহারকারী পথচারী ঝুঁকি নিয়ে মাঝ রাস্তা দিয়ে চলাচল করছেন। এদিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় এ সংকট কিছুটা প্রকট হলেও নগরীর অন্যান্য এলাকার চিত্রও অনেকটা একই রকম। বেশকিছু এলাকায় ফুটপাত থেকে হকারদের তুলে দেওয়ার পর তাদের ভিন্ন কায়দায় ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। রামপুরা, উলন, মহানগর, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, মতিঝিল, নয়াপল্টন, মৌচাক, নিউমার্কেট ও ধানমন্ডিসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে হকাররা তাদের পণ্যসামগ্রী ভ্যানে সাজিয়ে রাস্তার পাশে বিক্রি করছেন। সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হলে হকাররা দ্রম্নত ভ্যান চালিয়ে অন্যত্র সরে পড়ছে। ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতা আগে ফুটপাতে হকার বসিয়ে চাঁদা আদায় করতেন, তারাই ভ্যান থেকে ঘণ্টা হিসেবে টাকা তুলছেন। এ ছাড়া পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে জানান এসব ভ্যানের হকার। এদিকে ফুটপাত থেকে হকার তুলে দিয়ে তাদের ভ্যানে মাল বিক্রি করার সুযোগ করে দেওয়ায় পথচারীদের পাশাপাশি যানবাহন চালকরা নতুন বিড়ম্বনায় পড়েছেন। কেননা, অপ্রশস্ত রাস্তার দু'ধারে বিপুল সংখ্যক ভ্যান দাঁড়ানোর কারণে একদিকে যেমন সেখানে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তেমনি অন্যদিকে, ফুটপাত ঘেঁষে ভ্যান দাঁড়ানো থাকায় পথচারীরাও তা নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে পারছেন না। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা এ ধরনের ফুটপাত এড়িয়ে চলছেন। মালিবাগের বাসিন্দা রাহেলা খাতুন জানান, এতদিন ফুটপাতে হকার থাকায় তিনি তার শিশুসন্তানকে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছেন। অথচ এখন হকাররা রাস্তার পাশ ঘেঁষে ভ্যানে পণ্য নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, আর খদ্দেররা ফুটপাতে জড়ো হয়ে তা কিনছেন। ফলে তাকে সন্তানকে নিয়ে মাঝ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এর চেয়ে আগেই ভালো ছিল বলে মন্তব্য করেন রাহেলা। সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন অভিভাবক আক্ষেপের সুরে জানান, তার বাসার গেট থেকে স্কুল পর্যন্ত গোটা রাস্তায় ফুটপাতের হকার উচ্ছেদের পর সেখানে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ বানানো হয়েছে। এ ছাড়া বেশকিছু দোকানি এখন তাদের দোকানের মালামাল ফুটপাতে জড়ো করে রাখছেন। আবার কেউ কেউ ফুটপাত ফাঁকা পেয়ে সেখানে গাড়ি পার্কিং করছেন। ফলে আগের চেয়ে এখন তাকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এদিকে ফুটপাত হকারমুক্ত হলেও তা অন্যদের বেদখলে চলে যাওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ পরস্পরকে দুষলেও এর সঙ্গে দুই পক্ষের যোগসাজশের অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা ফুটপাত দখল করে রিকশার গ্যারেজ, গাড়ি পার্কিং ও বস্তি গড়ে তুললেও এজন্য স্থানীয় থানা পুলিশকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিতে হচ্ছে। তা না দিলেই তারা সেখানে নানা ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। যদিও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল জোনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজ নেতারা সাময়িকভাবে নমনীয় থাকলেও তারা ফের আগের চেহারায় ফিরেছেন। তবে এদের অনেকে আগে প্রকাশ্যে এসব চাঁদাবাজি ও দখলবাজি চালালেও এখন তারা কেউ কেউ এবার যথেষ্ট রাখঢাক করার চেষ্টা করছেন। থানা পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা দলীয় প্রভাব খাটানোর পাশাপাশি পেশিশক্তিও দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহজাহানপুর এলাকার এক সাবেক পিআই (পেট্রোল ইন্সপেক্টর) এ প্রতিবেদককে জানান, তিনি এলাকার ফুটপাত থেকে কয়েকটি রাজনৈতিক কার্যালয় এবং রিকশার গ্যারেজ তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার পর স্থানীয় নেতারা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করেন। তিনি প্রশাসনকে প্রকৃত ঘটনা অবহিত করলেও তার কথায় কেউ কান দেননি। এ পরিস্থিতিতে তিনি নিজের চাকরি রক্ষার স্বার্থে এ বিষয়ে পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি। স্থানীয়রা জানান, ফুটপাতে রাজনৈতিক কার্যালয়, ক্লাব, রিকশার গ্যারেজ গড়ে ওঠা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি সংবাদ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। টিভি মিডিয়াও ভিডিও ফুটেজসহ বেশ কয়েক দফা নিউজ প্রচার করেছে। তবে এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং এসব খবর সংগ্রহে সংবাদকর্মীদের যারা সহায়তা করেছিলেন তাদের উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। নগর ও পরিবেশ আন্দোলনকারী বিশিষ্ট স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হুট করে চালানো উচ্ছেদ অভিযানগুলো একেবারেই মূল্যহীন; বরং এতে দুর্নীতির ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না হলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। ইকবাল হাবিব আরও বলেন, রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে সম্পৃক্ত করে রাস্তাঘাট ফুটপাত দখলমুক্ত করে পরেও তা রক্ষা করা যে সম্ভব তার প্রমাণ হলো ঢাকার তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এবং গাবতলী বাস টার্মিনাল। আর এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে গুলিস্তানে। সেখানে একটি ব্যস্ততম সড়ক কয়েক দফায় চেষ্টা করেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তা দখলমুক্ত করতে পারেনি। তাই শেষ পর্যন্ত নগরীর সব সড়ক ও ফুটপাত কবে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত হবে কিংবা আদৌ হবে কি না সেটি বলা সত্যিই কঠিন-যোগ করেন স্থপতি হাবিব।