শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ জালে সয়লাব উপকূল হুমকিতে মাছের বংশ বিস্তার

নিষিদ্ধ জাল 'চরগরা' মূলত তিন থেকে চারশ মিটার লম্বা ও দেড় থেকে দুই মিটার চওড়া জাল যা খুবই সূক্ষ্ণ ফাঁসের
যাযাদি ডেস্ক
  ০৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

বরগুনাসহ গোটা উপকূলীয় এলাকার নদী তীরবর্তী চর ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে কিছু অসাধু জেলে। এতে প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রজাতির লাখ লাখ সামুদ্রিক মাছ ও পোনা মারা পড়ছে।

নিষিদ্ধ জাল 'চরগরা' মূলত তিন থেকে চারশ মিটার লম্বা ও দেড় থেকে দুই মিটার চওড়া জাল যা খুবই সূক্ষ্ণ ফাঁসের। এসব জাল ভাটিতে নদীর ঢালের চরে খুঁটি পুঁতে বেঁধে রাখা হয়। জোয়ারে জাল তুলে খুঁটিতে বেঁধে দেয়ার পর ভাটিতে পানি নেমে গেলে সমস্ত মাছ জালে আটকে যায়।

ঘোপও ঠিক একই রকমের জাল, চরগরার মতো এসব জাল বঙ্গোপসাগর ও নদীতে জেগে ওঠা চরের চারদিকে ভাটির সময় ছড়িয়ে রাখা হয়। জোয়ারের সময় এসব জাল নির্দিষ্ট উচ্চতায় খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়। ফের ভাটিতে জোয়ারের পানি নেমে গেলে সমস্ত মাছ এই সূক্ষ্ণ ফাঁসের জালে আটকে যায়। এসব জালে ছোট-বড় মাছের সঙ্গে একেবারে ক্ষুদ্র পোনাও বের হতে পারে না, এমনকি মাছের ডিমও নষ্ট হয়ে যায়।

শীত মৌসুমের শুরুতেই বঙ্গোপসাগরের মোহনাসহ এর আশপাশের চর ও নদী তীরবর্তী চরে বেহুন্দি, ঘোপ ও চরগড়া জালে মাছ শিকারের তৎপরতা শুরু হয়। বিশেষ করে পায়রা বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা চর, লালদিয়া হরিণঘাটা বনের কোলঘেঁষে চরাঞ্চল, বলেশ্বর তীরবর্তী পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, রুহিতা, ছোট টেংরা ও চর দুয়ানীতে চলে অবাধে নিষিদ্ধ মাছ শিকার।

একইভাবে কাঁঠালতলী এলাকার বেশকিছু জায়গায়, তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া, সোনাকাটা, নিদ্রা ও সখিনা এলাকা, বিষখালী নদীর গুলিশাখালী, মাঝের চর, ডালভাঙা এলাকা, পায়রা নদের গোরাপদ্মা, পালের বালিয়াতলী, কুমিরমারার চর, সোনাতলা সৃজিত বনাঞ্চল, বগিসহ তিনটি নদীর বিভিন্ন চরাঞ্চলে এই তিন ধরনের জালে সয়লাব হয়ে গেছে।

কোস্টগার্ড, বনবিভাগ ও মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করলেও কোনোভাবেই জেলেদের থামানো যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, নির্দিষ্ট মাসোহারার বিনিময়ে জেলেদের জাল পাতার সুযোগ করে দিচ্ছে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ।

এছাড়াও কুয়াকাটার চড় গঙ্গামতি, ফাতরার চর মহিপুর এলাকার নদী তীরবর্তী চর ও নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরে এসব নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে।

চর গঙ্গামতি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সমুদ্র তীর থেকে শুরু করে

সৈকতের এক বিরাট অংশ জুড়ে খুঁটি পুঁতে চরগড়া জাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও নতুন জেগে ওঠা চর বিজয়ের গোটা এলাকা জুড়েই চরগড়ার বিস্তার।

কোস্টাল এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন নেটওয়ার্কের সভাপতি আরিফ রহমান বলেন, 'চরগড়া, ঘোপ ও বেহুন্দির মতো নিষিদ্ধ জালের অত্যাচারে একদিকে যেমন বন উজাড় হয়, তেমনি উপকূলের প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিনে দিনে এসব জালে মাছ শিকারের হার বাড়ছে সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে। এদের নিবৃত করা জরুরি।'

স্থানীয়রা জানান, বিষখালী নদী ও বলেশ্বর নদের ও পায়রার মোহনায় কমপক্ষে ৩০টি ঘোপ ও চরগড়া দিয়ে পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে অবাধে।

পাথরঘাটার হরিণঘাটা এলাকার বাসিন্দা ও জেলে নুরুল ইসলাম, কালাম মিয়া ও আবুল হোসেন জানান, চরগড়া দিয়ে মাছ শিকারে অনেক জেলেকে নিষেধ করা হলেও তারা উল্টো ভয়-ভীতি দেখায়। তারা চরগড়া, ঘোপ, চিংড়ি, বেহুন্দি ও কারেন্টজাল বন্ধে প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের দাবি জানান।

পাথরঘাটা সদর উপজেলার সোনাতলা মৎস্য হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, 'আমাদের নদ-নদী মাছে ভরপুর। কিন্তু যেভাবে বরগুনার বিভিন্ন নদ-নদী ও মোহনায় জেগে ওঠা চরে চরগড়া ও ঘোপ জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে, তাতে মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে পড়বে।'

উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, 'এই জেলেদের ব্যাপারে একাধিকবার জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা হয়েছে। এদের ডেকে একাধিকবার বৈঠক করে এসব জাল ব্যবহারের নিষেধ করা হয়েছে, কিন্তু কে কার কথা শোনে?'

এক একটি ঘোপ বা চরগরা তৈরিতে শতাধিক গেওয়া ও কেওড়া গাছের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। এসব গাছ সিংহভাগই বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে লালদিয়া, হরিণঘাটা ও চরলাঠিমারা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কেটে আনা হয়। কম বয়সী লাঠি আকৃতির গাছ খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নতুন জন্ম নেওয়া গাছ কাটার ফলে সংরক্ষিত বনও উজাড়ের হুমকিতে রয়েছে।

সরেজমিনে পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, রুহিতা হরিণঘাটা ও টেংরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সংরক্ষিত বন থেকে গাছ কেটে খুঁটি বানিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে চরগড়ার জন্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এখানকার সবচেয়ে বড় চরগরার মালিক হিরন। তার সাথে কথা হয় এ বিষয়ে। গত বছর খুলনা থেকে চরগড়ার অনুমতি এনে মাছ ধরেছেন বলে জানান হিরন। তবে তিনি বলেন, 'আমার চরগরা বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমি এর সঙ্গে জড়িত নই।'

পাথরঘাটা উপজেলা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, 'বনের গাছ কেটে চরগড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে- এ ধরনের কথা শুনেছি। এ বিষয়ে তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। যদি কেউ গাছ কেটে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তবে তিনি জনবল ও দ্রম্নতগামী নৌযানের অভাবের কথা উলেস্নখ করে বলেন, 'অনেক সময় গাছ কাটার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেতে যেতে তারা পালিয়ে যায়।'

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রবীন্দ্রনাথ মল বলেন, 'অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকারের বিরুদ্ধে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা আশাবাদী, এই অভিযানের ফলে বরগুনাসহ উপকূলের নদ-নদী অবৈধ জালমুক্ত হবে'।

কোস্টগার্ড পাথরঘাটা ঘাঁটির কমান্ডার বিশ্বজিৎ বড়ুয়া বলেন, 'আমরা এসব জাল নিধনে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। জেলেরা কিছুটা বেপরোয়া ও ধূর্ত প্রকৃতির। আমরা এদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানও পরিচালনা করে থাকি। মূলত, আমাদের প্রচেষ্টার ত্রুটি থাকে না। তবু চোখ এড়িয়ে এরা শিকার করলে আমরা সেখানেও অভিযান পরিচালনা করব। '

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিলস্নাহ বলেন, 'অসাধু এসব জেলেদের নিবৃত্ত করতে আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। বিভিন্ন সময়ে এদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এছাড়াও তাদেরকে নিয়ে আমরা বিভিন্ন সময়ে সভা ডেকে এসব জালের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করেছি। এরপরও আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। ' রাইজিং বিডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<83135 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1