মেডিকেল বর্জ্য জনস্বাস্থ্যে হুমকি!

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
যাযাদি রিপোর্ট পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মেডিক্যাল বর্জ্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বর্জ্য হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডে, অপারেশন থিয়েটারে, আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) বিভিন্ন ডাস্টবিনে রাখা হয়। প্রতিদিনের বর্জ্য কিছু সময় পরপর আলাদা করে পৃথক পৃথক ডাস্টবিনে রাখা হয়। তারপরও ড্রেসিংয়ের গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা থেকে জীবাণুর মাধ্যমে ইনফেকশন ছড়ানোর ঝুঁকি থেকেই যায়। বিশেষ করে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৮ সালে আইন পাস হয়। যদিও তার কার্যকারিতা খুবই কম। যে কারণে হাসপাতালের মেডিক্যাল বর্জ্য এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা পস্নান্ট থাকা জরুরি হলেও কেবল ঢাকা এবং রাজশাহী ছাড়া এই পস্নান্ট আর কোথাও নেই। সরেজমিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, মেডিক্যাল বর্জ্যের ভেতরে রয়েছে ওষুধ ও ওষুধের বোতল, ইনজেকশনের শিশি-সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ-গজ, স্যালাইনের প্যাকেট, বস্নাড ব্যাগ, রক্ত ও পুঁজমাখা তুলা-গজসহ নানা মেডিক্যাল দ্রব্য। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, লাল, কালো এবং হলুদ রঙের পৃথক পৃথক ড্রামে করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মেডিক্যাল বর্জ্য পরিবহণের কাজ করছেন। কথা বলে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী লাল ড্রামে সিরিঞ্জ, সিরিঞ্জের খোসা, অ্যাম্পুল, গজ-ব্যান্ডেজ, সুই জাতীয় অর্থাৎ ইনফেকশন ছড়াতে পারে এমন বর্জ্য রাখা হয়। কালো ড্রামে রাখা হয় শুকনো পদার্থ আর হলুদ ড্রামে রাখা হয় পচা আবর্জনা। তবে সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বড় ড্রামে সেসব বর্জ্য রাখা হলেও প্রায় উপচে পড়া অবস্থা প্রতিটি ড্রামের। মেঝেতে পড়ে আছে সিরিঞ্জ, স্যালাইনের ব্যাগ, গজ-ব্যান্ডেজ-তুলা, ইনজেকশনসহ নানাকিছু। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বলছেন, সকাল আটটার আগেই হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের মাঠের পাশে একটি ভবনের ফাঁকা জায়গাতে এসব বর্জ্য জড়ো করা হয়। সেখান থেকে বেসরকারি একটি সংস্থা এসব বর্জ্য নিয়ে যায়। ছয় মাস ধরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছেন রবি চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, কাজ করার পর থেকেই হাতের চামড়ায় ফুসকুড়ি দেখা যাচ্ছে, সেগুলো ভীষণ চুলকায়। ধারণা করছেন, এ কাজে যোগ দেওয়ার কারণেই এমনটা হচ্ছে। তবে ছেড়ে যে যাবেন সে উপায়ও নেই, কাজ করেইতো পেট চালাতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মী বলেন, এখানে কাজ করার পর অনেকেই অ্যাজমা, চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসকরা তাদের জানিয়েছেন, বছরের পর বছর এসব (মেডিক্যাল বর্জ্য) নিয়ে কাজ করার জন্যই তাদের এ অবস্থা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, যারা বর্জ্য নিয়ে কাজ করেন তারা যক্ষ্ণা, চর্মরোগসহ নানান অসুখে ভুগছেন। পাশাপাশি তারা নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস বি এবং সি ব্রংকিউলাইটিস, অ্যাজমা, হাঁপানিসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোর মেডিক্যাল বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা যেমন নেই। এছাড়া আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবও রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একাধিকবার হাসপাতালগুলোকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যেসব হাসপাতালের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে তারা ব্যবস্থাপনা করে। কিন্তু যাদের নেই তাদের একের পর এক নোটিশ করা হচ্ছে। কোনো কোনো হাসপাতাল নোটিশ পাওয়ার পর কাজ করছে। যারা করছে না, নোটিশ দেওয়ার পরও যারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুলস্নাহ বলেন, মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, যারা মেডিক্যাল বর্জ্য 'হ্যান্ডেল' করেন তারা বিরাট হুমকিতে। তাদের চর্মরোগ হয়, বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্জি, একজিমা বেশি হয়। এছাড়াও শ্বাসনালির বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রংকিউলাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, সাইনোসাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়। তবে তাদের শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাগুলো বেশি হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব কর্মীর জন্য সরকারিভাবে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে ঝুঁকিভাতা রাখা প্রয়োজন। ঝুঁকিভাতা দিলে অন্তত এই মানুষগুলোকে কিছুটা হলেও সুরক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হবে। জাতীয় বক্ষ্যব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. বশীর উদ্দিন বলেন, যারা কাজ করেন তাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। গস্নাভস, মাস্ক বিশেষ ধরনের পোশাক পরে ওই নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে হবে। টিবি (যক্ষ্ণা) রোগীদের জন্য যে মাস্ক (এন-৯৫) সেটা এসব বর্জ্য পরিচ্ছন্নতাকারীদের জন্য দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর দামটা অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের দেশে সব জায়গাতে দেওয়া হয় না। এই মাস্ক দিলে ঝুঁকিটা অনেক কমত। তারপরও 'রিস্ক' থেকে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, যত ধরনেরই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, যে কোনো 'মেডিক্যাল ওয়েস্টেজ'ই ক্ষতিকারক এবং এর থেকে ইনফেক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিছু না কিছু ঝুঁকি থেকেই যায়।