রহস্যঘেরা বাবুর মৃতু্য!

প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
আবু বক্কর সিদ্দিকী বাবু
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতখানা থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিকী বাবুর মৃতু্য এখনো রহস্যবৃত্তে রয়েছে। পুলিশের দাবি, তিনি গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে বাবুর স্বজন ও সহকর্মীদের দাবি, হাজতখানায় ৫ আসামির মধ্য থেকে তিনি কীভাবে আত্মহত্যা করলেন? ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মাথা ও পায়ে আঘাতের কথা বললেও তা মৃতু্যর কারণ কি না তা পরিষ্কার করেননি। এমন পরিস্থিতিতে নিহতের গলার টিসু্য সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে বাবুর মৃতু্যর ঘটনায় সোমবার সকালে বিএফডিসির সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তার সহকর্মীরা। এসময় তারা ওসির ফাঁসি দাবি করেন। পরে সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাসে তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেন। এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। সোমবার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে নবগঠিত বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটি শ্রদ্ধা জানাতে গেলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, 'থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামির মৃতু্যর দায় পুলিশ এড়াতে পারে না।' এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, ফুটেজে আত্মহত্যার বিষয়টি দেখা গেছে। ওই হাজতখানায় আরও ৪ আসামি ছিলেন। তারা সে সময় ঘুমাচ্ছিলেন। যেহেতু হাজতখানায় মৃতু্য হয়েছে, একটা নিয়ে জুডিশিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন হবে। এ কারণে আমরা তদন্ত কমিটি ছাড়া ওই ফুটেজ কাউকে সরবরাহ করব না। পাশাপাশি এ ঘটনায় পুলিশের গাফলতির বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখানে কারো গাফলতির থাকলে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কারওয়ান বাজারের এক মাছের আড়ৎদারের স্ত্রীর সঙ্গে দুই বছরের অধিক সময় ধরে পরকিয়া চলছিল এফডিসির ফ্লোর অ্যান্ড সেট ইনচার্জ আবু বক্কর সিদ্দিক বাবুর। দুই সন্তানের জননী ওই গৃহবধূর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজ স্ত্রীকেও তালাক দিয়েছিলেন। নতুন সংসার করার আশায় বাবু মোহাম্মদপুর চন্দ্রিমা উদ্যান 'সি' বস্নকের ৪ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়িতে বাসাও ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই গৃহবধূ তার স্বামী-সংসারের মায়া ত্যাগ করতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে একটি কাবিননামাও তৈরি করেন বাবু। ওই কাবিননামা গৃহবধূর ম্যাসেঞ্জারে পাঠান বাবু। এতে ভয় পেয়ে যান ওই গৃহবধূ। এরপর গত ২৭ ডিসেম্বর সকালে গৃহবধূকে ফোন করে মীমাংসার কথা বলে চন্দ্রিমা উদ্যানের বাসায় ডেকে নেন বাবু। সেখানে যাওয়ার পর ভয়ভীতি দেখিয়ে আবারও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তা গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেন। পরে ১৩ জানুয়ারি বাবু ওই গৃহবধূর হোয়াটস অ্যাপস নম্বরে আপত্তিকর কিছু ছবি পাঠান। এরপর ওই গৃহবধূ বিষয়টি তার স্বামীকে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হন। ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সাতরাস্তা এলাকায় বাবুকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন আক্তার ও তার সহযোগীরা। পরে গৃহবধূ বাবুকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় বাবুকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শিল্পাঞ্চল থানার হাজতখানায় রাখা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই মামলার আসামি বাবু রাত ৩টা ২৫ মিনিটে হাজতখানার গ্রিলের সঙ্গে গলায় চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। তবে নিহতের ছেলে ফারদিন ইসলাম বলেন, পুলিশ বলছে আমার বাবা গলায় চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার গলায় যে দাগ আছে তাতে মনে হচ্ছে গলায় তার বা শক্ত সুতা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার মাথা, হাত-পা এবং মুখেও আঘাতের চিহ্ন আছে। তিনি জানান, তার বাবা কোনো ধরনের খারাপ কাজে জড়িত ছিলেন না। তার নামে আগের কোনো মামলাও নেই। লাশ উদ্ধারের পর বাবাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানতে পেরেছি। পরে মেডিকেলে এসে লাশ শনাক্ত করি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, মৃতু্যর সঠিক কারণ এখনই বলা সম্ভব নয়। তার মাথা ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সেগুলো মরার জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারনে আমরা তার নেক টিসু্য ও ভিষেরা সংগ্রহ করে পর্যালোচনার জন্য পাঠিয়েছি। সেগুলো হাতে পাওয়ার পরই মৃতু্যর কারণ বলা সম্ভব হবে। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপস্নব বিজয় তালুকদার বলেন, নিহতের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে হাজত খানায় রাখা হলে তিনি হাজতের গ্রিলের সঙ্গে চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি জানান, গোটা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করা হবে। উলেস্নখ্য, শনিবার রাতে আটকের কয়েক ঘন্টা পর রোববার ভোরে শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ মৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান বাবুকে। সেখানে বলা হয় থানার হাজতখানায় গলায় শিতের কাপড় পেচিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার পর থেকে পুলিশের দাবির বিরোধিতা করে আসছে স্বজন ও সহকর্মীরা। তাদের দাবি নির্যাতনে মৃতু্যর পর আত্মহত্যা বলে চালানো চেষ্টা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।