ঈদযাত্রায় ভোগান্তি চরমে

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় Ñযাযাদি
সোমবার ছিল এবার ঈদুল আজহার আগে শেষ কমির্দবস। তাই সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করে বাস, ট্রেন ও লঞ্চঘাটগুলোতে। তবে লঞ্চ ও বাসের যাত্রীরা তুলনামূলক কম ভোগান্তিতে রাজধানী ছাড়তে পারলেও ট্রেনের যাত্রীদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। দুই থেকে সবোর্চ্চ আট ঘণ্টা পরে ছেড়েছে অনেক ট্রেন। ফলে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় আছড়ে পড়ে কমলাপুরের রেলস্টেশনের বাইরের সড়কেও। বাসযাত্রায় অধিকাংশ রুটে স্বস্তি থাকলেও পদ্মা নদী সংলঘœ কয়েকটি ঘাট ও টাঙ্গাইলের কয়েক কিলোমিটার যানজটের কারণে দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের মানুষকে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তবে তীব্র চাপের মধ্যেও শান্তিপূণর্ভাবে বাড়ি ফিরেছেন বরিশাল বিভাগের লঞ্চযোগে ঢাকা ছাড়া মানুষেরা। এদিকে সোমবার দেশের সড়ক মহাসড়কের কয়েক স্থানে বেশ কিছু দুঘর্টনায় মারা গেছে ডজনেরও বেশি মানুষ। ঢাকা, ফেনী, সিরাজগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মাদারীপুর ও গাজীপুরে ঘটেছে এসব দুঘর্টনা। ফলে সড়ক পথে বাড়ি ফেরাদের মধ্যে ছিল কিছুটা অস্বস্তিও। তবে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আপনজনের সঙ্গে ঈদ করতে পারার আনন্দ সব প্রতিক‚লতাকে ছাপিয়ে গেছে। ট্রেন: ঈদের আগে শেষ কমির্দবসে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে ট্রেনের অপেক্ষায় দীঘর্ ভোগান্তি পোহাতে হয় ঘরমুখো যাত্রীদের। সোমবারও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন রুটের ট্রেন নিধাির্রত সময়ের চেয়ে দেরি করে স্টেশনে এসেছে। ফলে সেগুলো ছেড়ে গেছে আরও দেরি করে। প্রতিটি ট্রেনেই দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় এবং লালমনি ঈদ স্পেশাল ট্রেন সকাল সোয়া ৯টায় ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু রংপুর এক্সপ্রেস দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্ল্যাটফমের্ এসে ১টার দিকে স্টেশন ছেড়ে যায়। আর লালমনিরহাট ঈদ স্পেশাল ঢাকা ছাড়ে বেলা পৌনে ৩টায়। রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা সকাল ৬টায়। প্রায় তিন ঘণ্টা দেরি করে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে কমলাপুরে পেঁৗছানোর পর সোয়া ৯টায় যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি কমলাপুর ছাড়ে। এ ছাড়া সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৬টা ২০ মিনিটের পরিবতের্ সকাল সাড়ে ৮টায়, দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল পৌনে ৯টার জায়গায় সোয়া ৯টায়, চিলাহাটির নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৮টার জায়গায় চার ঘণ্টা দেরি করে দুপুর ১২টায় ঢাকা ছাড়ে। দেওয়ানগঞ্জের তিস্তা এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৭টার পরিবতের্ ঢাকা ছেড়ে যায় সাড়ে ৯টায়। তবে দিনাজপুরের একতা এক্সপ্রেস খুব বেশি দেরি করেনি। সকাল ১০টার বদলে ট্রেনটি রওনা হয়েছে ১০টা ১০ মিনিটে। ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ায় ভাদ্র মাসের গরমে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের। রংপুর এক্সপ্রেসের জন্য স্টেশনে অপেক্ষায় ছিলেন আরামবাগের একটি প্রিন্টিং কারখানার মালিক মোকসেদুল ইসলাম। ঈদ করতে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে রংপুরের মিঠাপুকুরে যাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ট্রেন ছিল ৮টায়। সকাল থেকে বসে আছি, ট্রেনই আসে না। একটু আগে জানাল ট্রেন নাকি দুপুর সাড়ে ১২টায় ছাড়বে। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।’ স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবতীর্ জানান, ‘অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। এ কারণে ট্রেনগুলো দেরিতে পৌঁছায়। এ ছাড়া বাড়তি যাত্রী উঠানামাতেও বেশি সময় লাগে। ফলে সেগুলো আসতেও দেরি করে। এ কারণে ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা যাচ্ছে না।’ এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডাবল লাইন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাস: অপরদিকে পদ্মার ওপারের কয়েকটি জেলা ও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা বাদে অন্য সবরুটের বাস যাত্রীরা গতকাল সোমবার স্বস্তিতেই বাড়ি ফিরেছেন। পদ্মা নদীর মাওয়া, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটগুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় নদীর ওপারের বাসগুলো যথা সময়ে কাউন্টারে পেঁৗছাতে পারেনি। ফলে এসব এলাকায় যাওয়ার উদ্দেশে কাউন্টারে আসা লোকজনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। একই রকমের অবস্থা ছিল রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলার মানুষেরও। টাঙ্গাইল ও যমুনা নদীর ওপরের বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন এলাকার যানজটের কারণে এ এলাকার গাড়িও ফিরতে বেশ দেরি করছে। ফলে উত্তরাঞ্চলের মানুষেরও বাড়ি ফিরতে বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। তবে দেশের অন্য রুটের বাসগুলো বেশ ভালোভাবেই রাজধানী ছেড়ে গেছে। মহাসড়কেও জটলা না থাকায় ভোগান্তিতেও পড়তে হয়নি তাদের। ঈদের দুদিন আগে সোমবার রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর ও টেকনিক্যাল মোড়ের বাস কাউন্টারগুলোতে ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। বাসের কাউন্টার ব্যবস্থাপকরা জানিয়েছেন, ফেরার সময় কয়েকটি রুটের মহাসড়কে যানজটের কারণে বাস ঢাকায় আসতে দেরি হচ্ছে। যার প্রভাব কাউন্টারেও পড়ছে। উত্তরাঞ্চলের রুটে টাঙ্গাইলে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রুটের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে তীব্র জটের কারণে এ রুটের সব গাড়িই অনেক দেরিতে কাউন্টারে এসে পেঁৗছায়। তবে মাওয়া ঘাটে যানজন তুলনামূলক কিছুটা কম বলেও জানিয়েছেন বাস কাউন্টারের কমর্কতার্রা। সকাল সাড়ে ৮টায় শ্যামলী পরিবহনের দিনাজপুরগামী বাসের জন্য যাত্রীদের কল্যাণপুর থেকে গাবতলী নেয়া হয় পৌনে ১১টায়। সেই বাসের জন্য কল্যাণপুর কাউন্টারে সকাল ৮টা থেকে অপেক্ষায় ছিলেন আয়েশা খাতুন। প্রায় তিন ঘণ্টা দেরি হলেও একটুপর বাস ছাড়বে ওতেই খুশি তিনি। আয়েশা বলেন, ‘অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। বলেছে, রাস্তায় জ্যাম। এখন ছোট বাসে গাবতলী নিয়ে যাচ্ছে। এরপর সেখান থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে রওনা করবে। দেখি কী হয়।’ শ্যামলী পরিবহনে সাড়ে ৮টার গাড়িতে রংপুরের যাত্রীরাও বাড়ির পথ ধরতে পারেন পৌনে ১১টায়। তবে কুষ্টিয়াগামী ১১টার বাসও সময়ের বেশকিছুটা পরেই কাউন্টারে এসে পেঁৗছায়। বাস দেরির কারণ জানতে চাইলে ঘাট ও গাবতলী এলাকার যানজটকে দায়ী করেন শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শাহজাহান সিরাজ। রোববার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরতে দেরি হলেও শিডিউল বিপযর্য় ঘটেনি বলে দাবি করেন হানিফ এন্টারপ্রাইজের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক একেএম রইসুল আলম সবুজ। বেলা ১১টার দিকে তিনি বলেন, ‘রাতে টাঙ্গাইলে তীব্র জ্যাম ছিল, এখন অনেকটাই ক্লিয়ার হয়ে গেছে। তবে বিকালে একটু বাজে অবস্থা হতে পারে।’ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে জটের কারণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন পরিবহনের বাস ফিরতে দেরি হচ্ছে। ফলে কোনো কোনো পরিবহন বাস আসার প্রেক্ষিতে বিক্রি করছিল ইনস্টান্ট টিকিট। টিকিটের জন্য দুপুর ১টার দিকে অনেককে অপেক্ষা করতে দেখা যায় ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ রুটের গোল্ডেন লাইন পরিবহনের সামনে। তাদেরই একজন ফরিদপুরের যাত্রী ইমতিয়াজ শাওন। তিনি বলেন, ‘টিকিট চাইছি, বলল রান্তায় জ্যাম আছে। গাড়ি আসলে টিকিট দিবে। কখন গাড়ি আসে কখন দেয় জানি না।’ ওই কাউন্টারের কমীর্ মোস্তাফিজ বলেন, ‘ফেরিঘাটে জ্যাম থাকবেই। সে কারণে আমরা আগে টিকিট না দিয়ে গাড়ি আসার প্রেক্ষিতে টিকিট দিচ্ছি।’ গ্রিন লাইনের এমন উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগতম জানিয়েছেন। সকালের দিকে টামির্নালে যে ভিড় ছিল তা বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র হচ্ছিল। বিকাল নাগাদ কাউন্টারগুলোতে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপ ভীষণভাবে বেড়ে যায়। এ সময় কিছু বাসকে ছাদেও যাত্রী নিয়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যেতে দেখা যায়। মানুষের চাপ আর গরুবাহী গাড়ির কারণে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে গাবতলী পযর্ন্ত দীঘর্ যানজট দেখা যায়। তবে গাড়ি চলন্ত অবস্থায় রাখতে ব্যস্ত ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। তবে উত্তরাঞ্চল ও পদ্মার ওপারের যাত্রীদের এতসব ভোগান্তি সত্তে¡ও চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যান্য রুটগুলোর যাত্রীরা শান্তিপূণর্ভাবেই বাড়ি ফিরেছে এদিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও শান্তিপূণর্ যাত্রা নিশ্চিত করতে ছিলেন তৎপর। লঞ্চ: এদিকে সোমবার সদরঘাটের লঞ্চ টামির্নালেও বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড় ছিল অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে অনেক বেশি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বাড়তে থাকে। বিকাল নাগাদ লঞ্চঘাট এলাকার সামনের রাস্তা বাড়ি ফেরা মানুষের মিছিলে পরিণত হয়। তবে এত ভিড়ের মাঝেও অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে লঞ্চযোগে বাড়ি ফেরা মানুষের মধ্যে ছিল স্বস্তি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি এ রুটের যাত্রীদের। তবে লঞ্চ ছাড়ার নিধাির্রত সময়ের অনেক আগেই যাত্রীরা ডেকে বসে ছিলেন সিট ধরার অপেক্ষায়। সকাল সকাল এসে লঞ্চের ডেকে চাদর বিছিয়ে পরিবার নিয়ে বসে পড়েছিলেন পোশাককমীর্ হালিম মিয়া। বরিশালে নিজের বাড়ি যাবেন তিনি ঈদ করতে। সঙ্গে ছিল ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী। হালিম মিয়া বলেন, ‘গত ঈদে সন্তানদের নিয়ে ওদের দাদার বাড়িতে যেতে পারিনি। তাই এবার আগে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ছুটি পেতে দেরি হওয়ায় আজ যাচ্ছি।’ বসার একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলেও তার জন্য বাড়তি পয়সা খরচ করতে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন হালিম মিয়া। লঞ্চের ডেকে বসা একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেন, এমনিতে লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী তোলা হচ্ছে। তারপরও মাঝপথে থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে তারা জানতে পেরেছেন। এ কারণে অনেককে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যেতে হচ্ছে। তার ওপরে বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তার। এবার ঈদযাত্রায় সদরঘাট লঞ্চ টামির্নালের সাবির্ক প্রস্তুতি ভালো। ভোগান্তি ছাড়াই মানুষ যাতায়াত করছে বলে জানিয়েছেন সদরঘাটে পরিদশের্ন আসা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত ১০ আগস্ট থেকে শুরু করে অধিকাংশ মানুষ বাড়ি পেঁৗছে গেছে, বতর্মানে পোশাককমীের্দর বাড়ি ফেরার বাড়তি চাপ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, যাত্রী নিরাপত্তা ও হয়রানি বন্ধে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই হয়ে যাতে কোনো লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে যেতে না পারে সেদিকে কঠোর নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যাত্রীদেরও অসচেতনতা, বিশেষ করে ডেকের যাত্রীরা কোনো কিছুই না মেনে যার যার পছন্দের লঞ্চে দল বেঁধে উঠতে থাকে। বাধা দিতে গেলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সবার সমন্বয়ে এবার ঈদে সুষ্ঠুভাবে লঞ্চ পারাপার করার চেষ্টাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।