বইমেলা প্রতিদিন

বসন্ত-ভালোবাসায় রঙিন মেলা

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার সেই সঙ্গে ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাই বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও। ক্রেতা-দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলাপ্রাঙ্গণ -যাযাদি
বসন্ত আর ভালোবাসা দিবসের রং ছড়িয়ে তরুণ-তরুণীদের ঢল নামে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। শুক্রবার সারাদিনই বাহারি সাজে মেলায় এসেছেন পাঠক-দর্শনার্থীরা। সন্ধ্যার দিকে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বইমেলার আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, শাহবাগ ও দোয়েল চত্বর এলাকায়ও। আগত দর্শনার্থীদের ভিড়ে আশপাশের এলাকায় ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। তবুও যেন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। প্রচন্ড ভিড় ঠেলে মেলায় গিয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভালোবাসা দিবস পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উৎসব হলেও এ দেশে এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। আর এ দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বসন্তের পহেলা দিন তো আছেই। তাই তো তরুণ-তরুণীরা মাতিয়ে রেখেছিল ঢাকা। এটি আরও দৃশ্যমান হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। শুক্রবার বিকেলে তরুণ-তরুণীরা লাল, হলুদ ও বাসন্তীসহ নানা রঙের বাহারি পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরে মেলায় আসেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস হওয়ায় অনেকেই আগে থেকে ঘোরার পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাই প্রিয়জনের হাতটি ধরে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেকেই। সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, কলা ভবনের সামনের বটতলা, বাণিজ্যিক অনুষদসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসই ছিল বসন্তের রঙে রঙিন। সকাল থেকে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতিও ছিল মূলত সেখানেই। তবে বিকালের দিকে তারুণ্যের সে ঢল আছড়ে পড়ে প্রাণের বইমেলাতে। বেশি দর্শনার্থী মেলায় আসায় স্টলগুলোতেও বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে। এ দিনের অতিরিক্ত বিক্রয়কর্মী নিয়োগ করেও বিক্রেতাদের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রকাশকদের। খ্যাতনামা লেখক, বুদ্ধিজীবী ও কবিরাও মেলায় এসেছেন। পছন্দের লেখকের হাত থেকে বই কিনেছেন কেউ কেউ। আনিসুল হক, মোস্তফা কামাল ও ইমদাদুল হক মিলনসহ বিখ্যাত লেখকদের কাছে পেয়ে পাঠকরাও খুশি হয়েছেন। নিয়েছেন অটোগ্রাফ, তুলেছেন ছবি। আবিষ্কার প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা শারমিন বলেন, অন্যদিনের তুলনায় বেচাবিক্রি বেশ ভালো হয়েছে। সবাই প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে মেলায় এসে বই কিনছে। ভালোবাসার দিনে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ভালোবাসার গল্প নিয়ে রচিত উপন্যাস আর কবিতার বই। প্রকাশকদের সঙ্গে খুশি পাঠকরাও। রং-বেরঙের সাজ নিয়ে যাদের প্রত্যেকেই ঘুরে বেড়িয়েছেন এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। পছন্দ হওয়া মাত্রই কিনে নিয়েছেন প্রিয় লেখকের নতুন আসা বইটি। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর থেকে মেলায় এসেছেন সাইফুল ইসলাম অমি। আলাপকালে তিনি বলেন, মেলায় আজই প্রথম আসা। খুব ভালো লাগছে। উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে। তাছাড়া নজরুল, রবীন্দ্রনাথ পছন্দের লেখক। শিশুপ্রহর অন্যান্য দিনের চেয়ে শুক্রবারের বইমেলা একটু অন্যরকম হয়। কারণ এদিন মেলায় শিশুদের জন্য থাকে বিশেষ আয়োজন। এর ওপর বাড়তি হিসেবে ছিল বসন্তের প্রথম দিন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তাইতো লাল-হলুদে সেজে বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুপ্রহরে এসেছেন তারা। শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুরা মেতে ছিল হালুম, টুকটুকি, ইকরি-মিকরির আর শিকুর সঙ্গে। শিশুদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করতে বইমেলায় রয়েছে বিভিন্ন আয়োজন। সিসিমপুরের হালুম-টুকটুকিরা শিশুদের নেচে-গেয়ে শোনায়। শিশুপ্রহরের স্টেজের চারপাশে লেখা 'পড়া নতুন সুর, যাই চলো যাই সিসিমপুর', 'বই পড়ো, যত পারো', 'পড়ি বই, জানতে জানতে বড় হই', 'ইকরি গল্প শুনতে ভালোবাসে', 'পড়া খেলার নতুন সুর যাই চল যাই সিসিমপুর' ইত্যাদি। নতুন বই গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৩৬৯টি। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে- বাংলা একাডেমি এনেছে আসাদ চৌধুরীর গ্রন্থ 'সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু', গ্রন্থকুটির এনেছে কবি হাবীবুলস্নাহ সিরাজীর 'আমার পান্ডব', শিশুগ্রন্থ কুটির এনেছে 'একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ', অনুপম প্রকাশনী এনেছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'ছোট একটা নেংটি ইঁদুর', আনিসুল হকের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি', কথা প্রকাশ এনেছে ইমদাদুল হক মিলনের 'বাড়িটায় কে যেন থাকে', সালেক খোকনের 'দেশে বেড়াই', আগামী প্রকাশনী এনেছে মোহাম্মদ হাননানের 'শতাব্দীর বঙ্গবন্ধু', নির্মলেন্দু গুণের 'নির্বাচিত ছড়া', ফরিদুর রেজা সাগরের 'মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প', আলী ইমামের 'বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি' প্রভৃতি। মূলমঞ্চের আয়োজন শুক্রবার মেলার ১৩তম দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সকাল ১১টা  থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে। সকাল ১০টায় শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক-শাখায় ১০ জন এবং খ-শাখায় ১১ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আশরাফুল আলম।   বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আসাদ চৌধুরী রচিত সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শোয়াইব জিবরান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আনিসুর রহমান এবং নূরুন্নাহার মুক্তা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খুরশীদা বেগম। আলোচকবৃন্দ বলেন, 'সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থটিতে কবি আসাদ চৌধুরী অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর কথা, কাজ ও সংগ্রাম সবই ছিল মানুষের জন্য নিবেদিত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও জীবনদর্শন আমাদের জন্য চিরকালের আদর্শ। 'সংগ্রাম' শব্দটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, গ্রন্থের শিরোনাম আমাদের সামনে বজ্রকণ্ঠের এক মহানায়কের অবয়ব ফুটিয়ে তোলে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা গর্ব অনুভব করতে পারি যে, আমরা এ স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছি এবং বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে আমাদের আদর্শ হিসেবে পেয়েছি।' সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক খুরশীদা বেগম বলেন, একজন রাজনৈতিক নেতা মানবমুক্তির সংগ্রামে কীভাবে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে বঙ্গবন্ধু তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি ছিলেন একজন সহজাত রাজনীতিক। পৃথিবীতে মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন নেতা বিরল যাঁর ডাকে দুঃখ-দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  লেখক বলছি লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ফরিদ কবির, মাহবুব আজীজ, আফরোজা সোমা এবং চৌধুরী শহীদ কাদের।     কবিকণ্ঠে কবিতা কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, সাজ্‌জাদ আরেফিন, তারিক সুজাত এবং সুহিতা সুলতানা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আহ্‌কাম উলস্নাহ, সায়েরা হাবীব এবং নাজনীন নাজ। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম, তানভীর সজীব আলম, তানজিনা করিম স্বরলিপি, মুর্শিদ আনোয়ার, রাজিয়া সুলতানা এবং শরণ বড়ুয়া। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), সাহেদ সরকার বাপ্পী (প্যাড), সুমন রেজা খান (কি-বোর্ড), শাহরাজ চৌধুরী  (গিটার)।   আজ যা থাকছে আজ শনিবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৪তম দিন। মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর। সকাল ১০টায় শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে শাহ্‌জাহান কিবরিয়া রচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আনজীর লিটন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন হরিশংকর জলদাস এবং খালিদ মারুফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।