বইমেলা প্রতিদিন

ভালো বইয়ের খোঁজে পাঠক

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পছন্দের বই দেখে নিচ্ছেন কয়েকজন নারী বইপ্রেমী। ছবিটি রোববার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা
বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ মেলা যেন পাঠক লেখকদের মেলবন্ধনের এক অনবদ্য অনুষঙ্গ। বছর বছর মেলার আকার বাড়ছে। বাড়ছে লেখক-প্রকাশক ও বইয়ের সংখ্যা। প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হলেও তা পাঠক আকৃষ্ট করতে পারছে না। তাই পুরো মেলা ঘুরে দু-একটি বই হাতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন কেউ কেউ। আবার কেউ বই না কিনেই খালি হতে ফিরে যাচ্ছেন। এবারের গ্রন্থমেলায় গতকাল রোববার পর্যন্ত ১৫ দিনে প্রকাশিত হয়েছে ২ হাজার ৩৪০টি বই। কিন্তু এসব বইয়ের হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি বই পাঠক আকৃষ্ট করতে পেরেছে। গত বছর মেলায় প্রায় ৫ হাজার বই এসেছিল। সেখানেও ভালো মানের বইয়ের সংখ্যা খুবই কম ছিল।  প্রকাশকরা বলছেন, লেখকরা তাদের নিজেদের মতো করে লেখেন। যেসব লেখক তাদের আয়ত্বে থেকে লেখেন তাদের কিছু নির্দেশনা দিতে পারেন। তবে সেটি কতটুকু গ্রহণ করা হবে আর কতটুকু বর্জন করা হবে সে সিদ্ধান্ত লেখক নিজেই নিয়ে থাকেন। আর এ কারণে বইয়ের মান সম্পর্কে প্রকাশকরা পুরো দায় নিতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে লেখক আকৃষ্ট করার জন্য নিম্নমানের বইও ছাপছেন তারা। এ প্রসঙ্গে উৎস প্রকাশনীর প্রকাশক মোস্তফা সেলিম যায়যায়দিনকে বলেন, এখনকার সাহিত্য হচ্ছে ওপরতলার সাহিত্য, লেখকরাও শহরকেন্দ্রিক, লেখার মধ্যে তারা ফ্লাটের বর্ণনা দেন, ট্রাফিক জ্যামের বর্ণনা দেন। তাদের লেখায় পরিবেশ থাকে না, প্রকৃতি থাকে না, সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র থাকে না, সংগ্রামী মানুষের জীবনকাহিনীও থাকে না। এজন্য পাঠক মহলে নতুন বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমছে। আবিষ্কার প্রকাশনীর প্রকাশক দেলাওয়ার হাসান বলেন, এখন পাঠকদের চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেশি। যার কারণে অনেক নিম্নমানের বই বাজার দখল করে আছে। তবে লেখার মান নিশ্চিত করতে না পারলে বাজারে টিকে থাকা কঠিন বলে মনে করেন তিনি। বাংলা জার্নাল প্রকাশনীর প্রকাশক হাবিবুর রহমান রুমেল বলেন, ভালো-মন্দ বই যাচাই করার শেষ জায়গাটা হচ্ছে পাঠক। একজন পাঠকই ঠিক করবেন আসলে কোনটা বই কোনটা বই নয়। পাঠকরা ভালো বইয়ের খোঁজে মেলায় আসেন। কিন্তু মানসম্মত বই না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান অনেকেই। যা সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে প্রতিবাদক। রোববার সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকজন পাঠকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লেখক-প্রকাশকের চেয়ে মানসম্মত লেখা চান তারা। তবে সে লেখা লেখক কীভাবে লেখেন আর প্রকাশক কীভাবে সম্পাদনা করেন তা বিচার করতে চান না তারা। মূলত সৃজনশীল, তথ্যবহুল, ঐতিহাসিক, জীবনমুখী বা ফিকশনধর্মী বইই বেশি চান পাঠক। মিরপুর থেকে মেলায় আসেন নিসর্গ সজীব। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্টল ঘুরেছেন। নতুন বইগুলো বেশি দেখেছেন। কিন্তু মানসম্মত ভালো বই খুবই কম পেয়েছেন। দুই-তিন ঘণ্টা ঘুরে তিনটি বই কিনেছেন। বাংলা একাডেমির তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, পূর্বে প্রকাশিত ভালো বইয়ের নতুন সংস্করণ খুব কম। বেশিরভাগ নতুন বইয়ে শিক্ষণীয় উপাদান কম। বাংলা একাডেমিও এবার তেমন ভালো বই প্রকাশ করেনি। নতুন বই রোববার মেলায় এসেছে ১৪৬টি নতুন বই। এর মধ্যে আবিষ্কার প্রকাশনী এনেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদের 'ইসলাম ও উন্নত জীবন ব্যবস্থা', ফারহানা রহমানের 'আমি মিথিলা', শিরীণ আখতারের 'মৎস্য কন্যা' পেন্ডুলাম প্রকাশনী এনেছে জুয়েল মুস্তাফিজের কবিতার বই 'হোয়াট অ্যা বিউটিফুল ডেড বডি', কথাপ্রকাশ এনেছে শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকারগ্রন্থ 'লেখা নিয়ে কথা', সময় প্রকাশন এনেছে রুমা মোদকের গল্পগ্রন্থ 'সেলিব্রেটি অন্ধকারের রোশনাই', কবিতাভবন এনেছে নির্মলেন্দু গুণের 'অনুবাদিত কবিতাসমূহ' ও বাতিঘর এনেছে হরিশংকর জলদাসের 'বিভোর থাকার দিনগুলি' প্রভৃতি। মূলমঞ্চের আয়োজন রোববার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৫তম দিনের বিকালে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় পিয়াস মজিদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষক শাহিদা খাতুন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি শিহাব সরকার এবং গবেষক ড. ইসরাইল খান। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন পিয়াস মজিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রাবন্ধিক বলেন, ভাষা শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত এই মাসে বাংলা একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি শীর্ষক বইয়ের যে আলোচনা তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বইটির লেখক পিয়াস মজিদ গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছেন। বহু উৎস থেকে পুরানো বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, নথিপত্র প্রভৃতি ঘেঁটে অনেকের দৃষ্টির আগোচরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের মূল্যবান অনেকগুলো তথ্য সংগ্রহ ও একত্র করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলা একাডেমি- বইয়ে মুদ্রিত শিরোনামের তিনটি শব্দ অবিচ্ছেদ্য। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়। এ অধ্যায়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু; আর বাংলা একাডেমি মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিভূমি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার ভ্রূণকেন্দ্র। তিনি বলেন, ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতা অব্যবহিত পরবর্তী সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা একাডেমি। সে দিনের বাংলা একাডেমি তার কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে মানুষের জাতীয়তাবাদী মানসের ধারা বিকশিত করতে পেরেছিল। একাডেমির সেই ইতিহাস এই বইয়ের মধ্য দিয়ে আরও উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে।  সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, পিয়াস মজিদ রচিত মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি গ্রন্থটি মূলত বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক চেতনাকে ধারণ করেই রচিত। সাংস্কৃতিক চেতনা দিয়েও যে সংগ্রাম করা যায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। ভাষা আন্দোলনের পর থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলা একাডেমির দীর্ঘ অভিযাত্রার ইতিহাস ও অর্জন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ গ্রন্থ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।  লেখক বলছি লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মাসরুর আরেফিন, সোহেল হাসান গালিব, সৈয়দ জাহিদ হাসান এবং আলতাফ শাহনেওয়াজ।       কবিকণ্ঠে কবিতা কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি মাসুদুজ্জামান, মাহবুব আজীজ, জাহানারা পারভীন এবং আশরাফ জুয়েল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শিরিন ইসলাম, আজিজুল বাসার এবং মনিরুল ইসলাম। আজ ছিল আবুল ফারাহ্‌ মো. তোয়াহার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'বিশ্বভুবন', জিনিয়া জ্যোৎস্নার পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন 'জিনিয়া নৃত্যকলা একাডেমী' এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী'-এর পরিবেশনা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন শ্যামা প্রসাদ মজুমদার (কি-বোর্ড)।    আজ যা থাকছে   আজ ১৭ ফেব্রম্নয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৬তম দিন। মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত ৭ মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ এবং ড. কুতুব আজাদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।