সাহেব আলী হত্যা মামলার চাঞ্চল্যকর রহস্য উদ্‌ঘাটন

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
স্ত্রী-সন্তানদের না জানিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৃতীয় বিয়ে করেছিলেন কবিরাজ সাহেব আলী। সেখানে স্ত্রী মর্জিনার বাড়িতে ঘরজামাই ছিলেন তিনি। তবে গ্রামে বসবাসরত পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন সাহেব আলী সেখানে একটি মেসে বসবাস করেন। সেই সুবাদে ওই বাসায় ছেলে বাবুলের আসা-যাওয়া ছিল। এক পর্যায়ে মর্জিনার ছোট বোন রিনা বেগমের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করে বসেন। পুরো বিষয়টি জানতো মর্জিনার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু বিষয়টি জানতেন না সাহেব আলী। এমনকি রিনা বেগম সম্পর্কে খালা হয় সেটিও অজানা ছিল বাবুলের। কিন্তু মর্জিনার পরিবার বেশিদিন বিষয়টি সাহেব আলীর কাছে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। তবে বিষয়টি সাহেব আলী জেনে যাওয়ার পরপরই তাকে খুন করেন শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম, স্ত্রী মর্জিনা ও তার ছোট বোন রিনা বেগম। এরপর একটি ডোবায় লাশ গুম করে তারা বাসা ছেড়ে দেন। এলাকায় প্রচার করা হয় সাহেব আলী তার আগের সংসারে ফিরে গেছেন। ২০১৮ সালে গাজীপুরের এই হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) সদস্যরা। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা ইতিমধ্যে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও সিআইডির প্রধান চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল মামুন বলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলার সূত্র ধরে সাহেব আলীর ছেলে বাবলু হাসানের সঙ্গে মর্জিনার ছোট বোন রিনা বেগমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা বিয়েও করে। বিষয়টি সাহেব আলীসহ অনেকেই জানতেন না। তবে মর্জিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানতেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সাহেব আলী বিষয়টি জেনে যান। এ নিয়ে সাহেব আলী ও মর্জিনার মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। বিভেদের জের ধরে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘরের ভেতর বালিশ চাপা দিয়ে সাহেব আলীকে হত্যা করেন স্ত্রী মর্জিনা, শ্যালিকা রিনা এবং শাশুড়ি আনোয়ারা। ওইদিন রাত ২টার দিকে তিনজন মিলে লাশ বাসা থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে পতিত জমির পানির নিচে চাপা দিয়ে রাখে। ঘটনার দিন শ্যালক শরীফ এবং শ্বশুর আবদুস সালাম গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। পরদিন তারা বিষয়টি শরীফ এবং সালামকে জানান। পরে সবাই মিলে বাড়িওয়ালাকে বলে বাসা ছেড়ে দেন। তারা স্বাভাবিকভাবেই ওই বাসা থেকে চলে যান। এ কারণে তাদের ওপর পুলিশের সন্দেহ ছিল না। সিআইডির সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে সাহেব আলী গোপনে বিয়ে করেছিলেন গার্মেন্টকর্মী মর্জিনাকে। সাহেব আলীর পরিবারের লোকজন বিষয়টি জানতেন না। কুড়িগ্রামে তার দুই স্ত্রী ও বেশ কয়েকজন সন্তান ছিল; কিন্তু বিয়ের আগে মর্জিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, বর্তমানে তার কোনো স্ত্রী নেই, তবে সন্তান আছে। সাহেব আলীর পেশা ছিল কবিরাজি করা। তিনি মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেতেন; কিন্তু তৃতীয় স্ত্রী মর্জিনা বা মর্জিনার পরিবারের কাউকে নিয়ে যেতেন না। ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রম্নয়ারি জয়দেবপুর টেকেননগর এলাকা থেকে তার গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মতিউর রহমান বলেন, সাহেব আলী হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার ছেলে বাবলু হাসান বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন জয়দেবপুর থানার এসআই পরিমল বিশ্বাস। তিনি সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত, ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। এছাড়া নিহতের কললিস্ট পর্যালোচনা করেন। ১৬১ ধারায় নিকট আত্মীয় ও আশপাশের লোকজনের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু দুই মাসের তদন্তে তিনি মামলার কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেননি। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার সিআইডিকে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির এসআই জাহিদুল ইসলামকে। ওই বছরের ১০ অক্টোবর জাহিদুল ইসলামকে সিলেট রেঞ্জে বদলি করা হয়। পরে সিআইডি সদর দপ্তরের নির্দেশে সিআইডি গাজীপুর মেট্রোর পুলিশ পরিদর্শক রেজাউল করিমকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে দেখা যায়, মৃত সাহেব আলীর কুড়িগ্রামে দুই স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মর্জিনা নামে এক নারীকে তৃতীয় বিয়ে করেছিলেন। মর্জিনা একজন গার্মেন্টকর্মী। তিনি তার ভাই-বোন এবং বাবা-মাসহ ওই এলাকায় সৈয়দ মোর্শেদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাড়িতেই থাকতেন সাহেব আলী। ঘটনার ৫-৭ দিন পরই মর্জিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ওই সময় বাড়িওয়ালা সৈয়দ মোর্শেদ বরিশালে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। মর্জিনা বা তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি বাড়িওয়ালা সৈয়দ মোর্শেদ। পরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মর্জিনার গ্রামের বাড়ির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তদন্তের এক পর্যায়ে ঘাতকদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানার পাথারীগাঁও গ্রামে বলে জানা যায়। এরপর সিআইডির একটি টিম ওই গ্রামে ছদ্মবেশে অবস্থান করে। তারা এক বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাত্রী দেখতে যান। পাত্রী দেখার ফাঁকে তারা মর্জিনার বাবা সালাম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। ওই গ্রামের অধিকাংশ লোকজন তাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা দেন। এরপর সালামের পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে সিআইডির টিম ঢাকায় চলে আসে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের এক পর্যায়ে দেখা যায়, সালামের পরিবারের সদস্যরা ভালুকা সিডস্টোর এলাকায় থাকেন। প্রথমে সালামের ছেলে সবুজের কললিস্ট বের করে তাকে আটক করা হয়। এরপর তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মর্জিনা, রিনা এবং আনোয়ারাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা গত ১৯ জানুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। \হ