বইমেলা প্রতিদিন

জনস্রোতে উচ্ছল মেলা

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, কোথাও যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। চারপাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। দুপুরের পর শাহবাগ, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, ঢাকা মেডিকেল ও দোয়েল চত্বরের দিক থেকে মেলার দিকে জনস্রোত আসতে শুরু করে। বিকাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। এদিন রেকর্ডসংখ্যক ৫০৮টি নতুন বই প্রকাশ করা হয়। শুক্রবার একুশে ফেব্রম্নয়ারির দিন সকাল ৮টায় মেলার দ্বার খুলে দেওয়া হয়। শেষ হয় রাত সাড়ে ৮টায়। সকাল থেকেই মেলায় দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে মেলায় আসেন অনেকেই। তখন থেকেই ভিড় শুরু হয়। তবে দুপুরের পর থেকে মেলায় লোকসমাগম বাড়তে থাকে। বিকাল ও সন্ধ্যার দিকে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না কোথাও। আশপাশের সবগুলো সড়কে জনস্রোতের কারণে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা জানান, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষার্থে যারা জীবন দিয়েছিলেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বই সংগ্রহ করতে এসেছেন। উপচে পড়া ভিড়ে বিক্রিও বেশ ভালো হয়েছে। এবার নিয়ে ২য়বার মেলায় এসেছেন সরকারি চাকরিজীবী এ এস এম মামুন। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে শহিদ মিনারে ফুল দিতে এসেছিলেন। সেখান থেকে মেলায় এসে ঘুরেছেন। কিনেছেন পছন্দের বইও। আলাপকালে মামুন জানান, এবারের মেলার আয়োজন বেশ ভালো। স্টলগুলো দূরে দূরে থাকার কারণে আগের চেয়ে ভালো লেগেছে। ধুলাবালিও কম বলে জানান তিনি। জনশ্রোতের মধ্যে পছন্দের বই সংগ্রহ করতে হিমশিম খেয়েছেন ক্রেতারা। তবুও যেন ক্লান্তি নেই কারো। বরং থেমে থেমে ভেসে আসা 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রম্নয়ারি...' গানের সুর প্রাণের মেলা প্রত্যেকেই যেন আরো আবেগি, আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা মেলার চিত্তাকর্ষক দিন একুশে ফেব্রম্নয়ারির গ্রন্থমেলায় এ দৃশ্যই চিত্রিত হয়েছে দিনভর। ভিড় ঠেলে পছন্দের বই কিনেছেন তারা। বেশি বিক্রিতে প্রকাশকরাও খুশি। আলাপকালে আবিষ্কার প্রকাশনীর প্রকাশক দেলোয়ার হাসান যায়যায়দিনকে বলেন, বিক্রি আগের দিনগুলোর চেয়ে বেশি হয়েছে ঠিক। কিন্তু যে পরিমাণ লোকসামাগম হয়েছে সে তুলনায় বিক্রি হয়নি। বাংলা জার্নালের প্রকাশক হাবিবুর রহমান রুমেল বলেন, বেচাকেনা বেশ ভালো হয়েছে। সারাক্ষণই স্টলের সামনে মানুষের ভিড় ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বই বেশি বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি। রেকর্ডসংখ্যক নতুন বই প্রকাশ : অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২০তম দিনে রেকর্ডসংখ্যক ৫০৮টি নতুন বই এসছে। প্রায় সারাদিনই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে ব্যস্ত ছিলেন লেখকরা। এর মধ্যে বাংলা জার্নাল এনেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অরিন্দম নাথের লেখা গদ্যময় পৃথিবীর আখ্যান, আগামী প্রকাশনী এনেছে 'মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র'। আবিষ্কার এনেছে রবিউল হুসাইনের কাব্যগ্রন্থ 'কি আছে এই অন্ধকারের গভীরে'। মহাকাল প্রকাশ করেছে হাবীবুলস্নাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ 'ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন' ও রীনা মজুমদারের 'বাস্তবতার বেড়াজালে'। কথা প্রকাশ এনেছে মুনতাসীর মামুনের 'বাংলাদেশ ১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতনের রাজনীতি'। পুথিনিলয় এনেছে জাকির তালুকদার 'গল্প সমগ্র ২', বিপ্রদাশ বড়ুয়ার 'তিনটি গোয়েন্দা কাহিনী' ও ইমদাদুল হক মিলনের 'তোমার ভালোবাসা'। জ্ঞানকোষ এনেছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'আমার সাইন্টিস মামা' উলেস্নখযোগ্য। মূলমঞ্চ : গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। এতে শতাধিক নবীন-প্রবীণ কবি কবিতা পাঠে অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন কবি রুবী রহমান। বিকাল ৪টায় একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা। 'বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ' শীর্ষক একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুলস্নাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ বাঙালির কথা। তাঁর 'সোনার বাংলা' প্রত্যয়ে দেশ বাংলা ও বাঙালি এ দুই ধারণাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনে ছোট, জনসংখ্যায় বিশাল, এদেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে, খাদ্যসহ সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে হবে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর দেশ-দর্শনে সামাজিক ও শ্রেণিগত বৈষম্য আদৌ গ্রহণযোগ্য ছিল না। মহান এই নেতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তারই মতো অসমসাহসী ও বিচক্ষণ; তিনি তার পিতার, আমাদের জাতির জনকের 'স্বপ্নের সোনার বাংলা' গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য-দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।  সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ তার সব সমস্যা ও সংকট সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারায় যে অনেক ধাপ এগিয়ে গেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের ন্যায়পূর্ণ বণ্টন নিশ্চিতের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  কবিকণ্ঠে কবিতা : কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন মিনার মনসুর, শিহাব সরকার, আনিসুল হক এবং শেখর বরণ দাশ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মো. জালাল উদ্দিন হীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী'র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, কল্যাণী ঘোষ, বুলবুল মহলানবীশ, মহাদেব ঘোষ, সমর বড়ুয়া এবং নাহিদ নাজিয়া। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন রাজু চৌধুরী (তবলা), এনামুল হক টিংকু (গিটার), সুমন রেজা খান (কী-বোর্ড), মো. ফারুক (প্যাড)।  আজ যা থাকছে :  আজ ২২ ফেব্রম্নয়ারি শনিবার, অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২১তম দিন। মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আগামীকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত 'বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন ড. সোনিয়া নিশাত আমিন, গোলাম কুদ্দুছ এবং মামুন সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করবেন ড. মুহাম্মদ সামাদ। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।