বইমেলা প্রতিদিন

শিশুদের কলকাকলিতে মুখর মেলা

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ফয়সাল খান
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২১তম দিনে বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। গত দুই দিন ধরে শিশুদের উপস্থিতি মেলায় বাড়তি প্রাণের সঞ্চার করে। শনিবার বেলা ১১টায় দ্বার খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কচিকাঁচাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠে মেলা প্রঙ্গাণ। তাদের হইচই আর ছোটাছুটি শিশু চত্বর ছাড়িয়ে মেলার অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। বেলা ১১টায় শিশুপ্রহরের শুরুতেই বাবা-মায়ের হাত ধরে মেলায় প্রবেশ করে অসংখ্য শিশু-কিশোর। প্রবেশ করেই তাদের চোখ ছুটে যায় শিশু চত্বরে। তাদের দুরন্তপনায় অভিভাবকরাও উৎসাহ দেন। তাদের কিচিরমিচির সকলের প্রাণ ছুঁয়ে যায়। চারপাশ থেকে এ সময় অভিভাবকদের ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তবে কে ছবি তুলছে আর কে কী ভাবছে তা নিয়ে নেই সোনামণিদের এতটুকুও মাথাব্যথা। লাফাতে লাফাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ছুটে আসে বাবা মায়ের কোলে। অভিভাবকের কোলে চড়তে চড়তে জানাতে থাকেন 'আজ কিন্তু বই না নিয়ে বাড়ি ফিরব না।' আর সে বাহানা পূরণ করেই অভিভাবককে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। তবে বইয়ের দোকানে গিয়ে কোন বইটি কিনতে হবে তা নিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ে খুদে বইপ্রেমীরা। তাইতো সে দায়িত্বটি গিয়ে পড়ে অভিভাবকের কাঁধেই। বাবা-মা পছন্দের একাধিক বই কিনে দেন প্রিয় সন্তানকে। আর নতুন বই হাতে পেয়েই ছবি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শিশুপ্রহরের রাজা-রানিরা। ঘ্রাণ নিতে থাকে নতুন বইয়ের রগ চটানো গন্ধের। তাদের এ উচ্ছ্বাস চলে দুপুর পর্যন্ত। এই পুরো সময়টা মেলা ছিল শিশু-কিশোরদের দখলে। তবে শিশুপ্রহরে বাচ্চাদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও বিকালে বড়দের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এ সময় আর মেলা শুধু শিশুদের দখলে ছিল না। শিশুদের চেয়ে বড়দের পদচারণা বেশি ছিল। দুপুর ১২টার দিকে মেলার শিশু কর্নারের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, শিশুপ্রহরের সিসিমপুর, ঘাসফড়িং, টইটুম্বুর, শিশুরাজ্য, ঘুড়ি, পঙ্খিরাজ, কিশোর ভুবন, টোনাটুনির মেলাসহ বিভিন্ন প্রকাশনার সামনে বই কিনছেন শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকরা। তবে সকালে শিশুদের হলেও বড়দের বইয়ের দোকানগুলোও খুলে যায় এ সময়। তাই শিশুরা ছোটদের কর্নারের বাইরে বড়দের স্টলগুলোতেও ভিড় জমাতে থাকে। বড়দের স্টলগুলোও শিশুদের এ আগ্রহের কথা ভেবে বই ওঠাতে ভুল করেনি। সেখানেও রয়েছে শিশুদের বিপুল সংখ্যক বই। বেলা ৩টার পর থেকে মেলায় বড়-ছোট সকলের উপস্থিতি আবারও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে মেলায় উপচে পড়া ভিড় নামে। তবে যারা একটু বিকাল করে মেলার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন, তাদের প্রচন্ড যানজটে পড়তে হয়। বিশেষ করে টিএসসি থেকে নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, আজিমপুর এলাকায় বিকালে প্রচুর যানজট লেগে যায়। শুক্রবারের চেয়ে উপস্থিতি কম হলেও বিক্রিবাট্টা কম ছিল না। এদিনও শুক্রবারের মতো প্রকাশক-লেখকদের মুখে ছিল হাসির ঝিলিক। গতকাল বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। নতুন বই এসেছে ২৪২টি।      শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান : বেলা ১১টায় অমর একুশে উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুলস্নাহ সিরাজী। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির সচিব (ভারপ্রাপ্ত) অপরেশ কুমার ব্যানার্জী, অমর একুশে গ্রন্থমেলার সদস্যসচিব ড. জালাল আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ।  শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা : ক-শাখায় আবদুলস্নাহ আল সাদ (প্রথম), ঋষিত শীল ধৃতি (দ্বিতীয়), রুহান আবদুলস্নাহ (তৃতীয়)। খ-শাখায় মুনতাকা ইসলাম (প্রথম), নুজহাত তাসনীম রূপকথা (দ্বিতীয়), এস এম আবতাহী নূর (তৃতীয়)। গ-শাখায়  নুরুল আফতাব (প্রথম) আবির রায় চৌধুরী (দ্বিতীয়), আরমান ভূইয়া অর্ক (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।  শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় সুমাইতা নুসাইবা (প্রথম), ঋদ্ধ হাসান (দ্বিতীয়), আহ্‌নাফ বিন জামান (তৃতীয়)। খ-শাখায় যারীন সালসাবিল অর্পা (প্রথম), নওবা তাহিয়া হোসেন (দ্বিতীয়), আব্দুলস্নাহ আল হাসান মাহি (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।   শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় আফরা আদিলা রিমঝিম (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (দ্বিতীয়), ছুওয়াইবা কবির ও সুনিপুণ বড়ুয়া চৌধুরী (তৃতীয়)। খ-শাখায় তানিশা জাহান নরিকা (প্রথম), গার্গী ঘোষ (দ্বিতীয়) এবং ত্বাবীব ফাইরুজ রোদশী (তৃতীয়) স্থান লাভ করেন।  প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, প্রতিটি শিশুর ভেতরেই সৃষ্টিশীল প্রতিভা লুকিয়ে আছে। অভিভাবকদের দায়িত্ব হবে শিশুর এই প্রতিভা বিকাশের জন্য সুন্দর ও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।  সভাপতির বক্তব্যে হাবীবুলস্নাহ সিরাজী বলেন, আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে পারি তাহলে তারা ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।  মূলমঞ্চের অনুষ্ঠান : বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত 'বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ: বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. সোনিয়া নিশাত আমিন, গোলাম কুদ্দুছ এবং মামুন সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ। প্রাবন্ধিক বলেন, মুজিব শতবর্ষে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ, বিচার-বিবেচনার যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের নিবিড় ও গভীর পাঠ আমাদের কাম্য তার এক উদাহরণ হতে পারে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে প্রণীত বর্তমান গ্রন্থ। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ একান্তভাবে ৭ মার্চের ভাষণ ঘিরে আবর্তিত, তবে প্রায় দেড় দশকজুড়ে নিয়মিত বার্ষিক এই বঙ্গবন্ধু-চর্চায় রয়েছে ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তনময়তা, সেই সঙ্গে নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণ-পদ্ধতি অনুসরণ করে ৭ মার্চের ভাষণ পর্যালোচনার প্রয়াস। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের উদ্দীপক ভূমিকা নিয়ে যেসব লেখালেখি রয়েছে তা এর সার্থকতারই প্রকাশ।  সভাপতির বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম এক রাষ্ট্রদর্শন বলা যায়। বাঙালির ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এ ভাষণ নিয়ে নানামাত্রিক বিশ্লেষণ হয়েছে এবং হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধসমূহ বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করবে।  লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন সলিমুলস্নাহ খান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, সাখাওয়াত টিপু এবং চঞ্চল আশরাফ।     কবিকণ্ঠে কবিতা : কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি অসীম সাহা, মুহাম্মদ সামাদ, মাশুক চৌধুরী, ফরিদ কবির, সাইফুলস্নাহ মাহমুদ দুলাল, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, পিয়াস মজিদ এবং আলতাফ শাহনেওয়াজ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল মো. আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় 'আরশিনগর বাউল সংঘ'-এর শিল্পীবৃন্দের পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন সমীর বাউল, দেলোয়ার হোসেন বয়াতী, সুধীর মন্ডল, শ্যামল কুমার পাল, রাতুল শাহ, আঁখি আলম, বিমল বাউল। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন সঞ্জয় কুমার দাস (তবলা), মো. মামুন (বাঁশি), মো. আজিজুর রহমান (কি-বোর্ড), মো. খোকন (দোতারা), এবং আবদুস সোবহান (বাংলা ঢোল)।   আজ যা থাকছে : আজ ২৩ ফেব্রম্নয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২২তম দিনে মেলা চলবে বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে মুর্শিদা বিন্‌তে রহমান রচিত স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু : পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করবেন মুস্তাফিজ শফি। আলোচনায় অংশ নেবেন আখতার হুসেন, মাহবুব সাদিক এবং আলম খোরশেদ। সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।