মাদ্রাসার অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগে ক্ষমতা পেলেন ডিসি-ইউএনও

যায়যায়দিনে প্রতিবেদন প্রকাশের দিনই অধিদপ্তরের ব্যবস্থা মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা ঠেকাতে তৎপর অধিদপ্তরের একটি গ্রম্নপ

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

নূর মোহাম্মদ
অবশেষে সারাদেশে ৮ হাজারের বেশি মাদ্রাসা অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার ও সহসুপারের পদে নিয়োগ বোর্ডে প্রতিনিধি রাখার ক্ষমতা পেল জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। গত ১৮ ফেব্রম্নয়ারি 'অবশেষে মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগে ক্ষমতা পাচ্ছেন ডিসি-ইউএনওরা' যায়যায়দিনে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই নতুন নির্দেশনা জারি করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। ফলে গত সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আর কোনো বাধা রইল না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। মাদ্রাসা অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীসহ সকল পদের নিয়োগের জন্য নিজ নিজ জেলার জেলা প্রশাসক মহাপরিচালনের প্রতিনিধি হবেন বা তিনি প্রতিনিধি নিয়োগ দিবেন। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে মাদ্রাসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৮ ফেব্রম্নয়ারি নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এখন থেকে মাদ্রাসার সকল নিয়োগের অধিদপ্তরের প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট জেলার মাঠ প্রশাসন ডিসি-ইউএনওরা পালন করবেন। অতীতে কী হয়েছে সেটা আমি বলতে পারব না। তবে এ নির্দেশনার পর আর ব্যত্যয় হবে না বলেও জানান তিনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে আট হাজারে বেশি মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ. তদারকি, এমপিওসহ শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা নিয়ে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিসিরা। বিষয়টি আমলে নিয়ে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিবকে একটি নির্দেশনা দেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্দেশনায় বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুটি বিভাগের ভাগ হওয়ার পর কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তদারকি জন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা না থাকায় শিক্ষা কার্যকম দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় মাঠ পর্যায়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম তদারকি শিক্ষক নিয়োগের প্রতিনিধি ডিসি-ইউএনওদের দিতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদের এমন নির্দেশনা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার বাধার মুখে বাস্তবায়ন করতে পারেনি পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি যায়যায়দিনে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব। তিনি মহাপরিচালককের বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলে ওই দিনই অধিদপ্তর থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়। সচিব দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদ্রাসা অধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার ও সহসুপার ও কর্মচারী নিয়োগে অধিদপ্তরের প্রতিনিধি বাণিজ্যে সংক্রান্ত সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন খতিয়ে দেখে অধিদপ্তর থেকে সচিবকে জানানো হয়, শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসা উপপরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, সহকারী পরিচালক (অর্থ) আবদুল মুকীবের নেতৃত্বে একটি গ্রম্নপ সব নিয়োগে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছেন। তারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা অমান্য করে নিজেরাই বিভিন্ন জেলায় শিক্ষক নিয়োগের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হন। বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে চাকরির সুপারিশ করার পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে কর্মকর্তারা জানতে পারেন, মাদ্রাসা অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিনিধি প্রেরণের কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে মাদ্রাসা অধিদপ্তর আলাদা হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের প্রতিনিধি অধিদপ্তর থেকে পাঠানো হচ্ছে। এর সুযোগে তারা টাকা হাতিয়ে নিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে এমপিও দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। মাদ্রাসা অধিদপ্তরে তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৮০০০-এর বেশি মাদ্রাসার তদারকির জন্য মাদ্রাসা অধিদপ্তরে মহাপরিচালকসহ মাত্র ২০ জন কর্মকর্তা প্রেষণে কাজ করছেন। তিনটি বড় প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, কারিকুলাম তৈরি এবং অন্যান্য কাজকর্ম বেড়ে গেছে অধিদপ্তরের। নিজস্ব প্রশাসনিক কাজকর্ম ছাড়াও নিয়মিত মাদ্রাসা পরিদর্শন এবং প্রতিবেদন তৈরি, এমপিও দেওয়াসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকার পরও শিক্ষক নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় বলয় তৈরি করা এসব কর্মকর্তার। এর মধ্যে সারাদেশে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার ও সহকারী সুপার পদ শূন্য হওয়া পদগুলোর নিয়োগের জন্য প্রতিদিন গড়ে একশ]র বেশি আবেদন আসে অধিদপ্তরে। আর ২০১৪ সালের জনবল অনুযায়ী প্রতিটি মাদ্রাসায় আরও অতিরিক্ত তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রতিনিধি মনোনয়ন নিয়ে অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে বেশির ভাগ সময় কর্মকর্তাদের মাঠে থাকতে হয়। এতে অধিদপ্তরে অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসন সম্মেলনে ডিসিরা এসব সমস্যা তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক তদারকির দায়িত্ব ডিসি ও ইউএনওদের দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, মাঠ প্রশাসন এ দায়িত্ব পালন করলে নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি সারাদেশ থেকে শিক্ষকদের ঢাকায় আসতে হবে না। কর্মকর্তারা জানান, প্রতিনিধি মনোনয়নের জন্য দেশের প্রতিষ্ঠান প্রধানকে প্রতিদিন ঢাকায় আসতে হয়। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি অধিদপ্তরের কাজের চাপ বাড়ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা ঠেকাতে তৎপর হয়ে উঠেছে শিক্ষা ক্যাডারে একটি গ্রম্নপ। শিক্ষক নিয়োগে অধিদপ্তরের প্রতিনিধির ক্ষমতা ডিসি, ইউএনওদের হাতে দেওয়ার পর সেই অর্ডার বাতিল করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন শামসজ্জামানের নেতৃত্বে একটি গ্রম্নপ। গত বৃহস্পতিবার তারা শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও পারেনি। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের সঙ্গে দেখা করে অধিদপ্তরের ক্ষমতা খর্ব করার যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। সচিব বিষয়টি নিয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিবের সঙ্গে কথা বলেন বলেন। জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারে কর্মকর্তাদের প্রেষণ মঞ্জুর করে মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের ন্যস্ত করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। ফলে ন্যস্ত হওয়া বিভাগের হাতে এ সকল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। কোনো কিছু হলেই অভিযুক্তরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে না এসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে চলে যান। এটি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলার আরেকটি অন্তরায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।