ওয়েস্টিনের মালিক-কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতাও দেখা হবে:র্ যাব

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
গুলশানের ঢাকা ওয়েস্টিন হোটেলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেনশিয়াল সু্যইটটি ভাড়া নিয়ে নিচের সারির একজন রাজনৈতিক কর্মী মাসের পর মাস কী করে আসছিলেন, তা ওই পাঁচ তারা হোটেলের মালিক ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষের শীর্ষ ব্যক্তিরা ভালোভাবেই জানতেন বলের্ যাব কর্মকর্তাদের ধারণা। ওয়েস্টিনের ২২ তলায় চার বেডরুমের ওই সু্যইটের প্রতিরাতের ভাড়া সাধারণভাবে দুই হাজার ডলারের মতো। ওই সু্যইট ভাড়া নিয়েছিলেন যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া, যিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। ২৮ বছর বয়সি ওই নারী সমাজের উঁচুতলার লোকদের জন্য 'যৌনসেবার কারবার' চালাতেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ার কথা বলছেনর্ যাব কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, অনেক হোমরাচোমরা রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীর সঙ্গে পাপিয়ার যোগাযোগ ছিল, তাদের মধ্যে হোটেলের মালিকানা ও পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও আছেন। পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোনে বহু ভিডিও পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা, যেগুলো এখন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। র্ যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার বিন কাসেম বলেন, 'পাপিয়া হোটেলের ভেতরে তার কক্ষে এসব অপকর্ম করেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ তার অবৈধ কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে কি না বা তার কার্যক্রমকে বেগবান করতে অন্য কোনোভাবে সহযোগিতা করেছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে।' 'যদি তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।' ওই হোটেলের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ পাপিয়া প্রতি মাসে পরিশোধ করেছেন দেড় কোটি টাকার মতো, আর তার পুরোটাই তিনি নগদে দিয়েছেন বলের্ যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্য। তবে হোটেল কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি নন। র্ যাবের এক অভিযানে গত শনিবার ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া ওরফে পিউ, তার স্বামী নরসিংদীর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং তাদের সহযোগী আরও দুজন। তাদের কাছে পাওয়া যায় বিদেশি মুদ্রা ও জাল নোট। র্ যাব-১ এর অধিনায়ক শাফী উলস্নাহ বুলবুল সেদিন বলেন, পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের 'প্রেসিডেনশিয়াল সু্যইট' ভাড়া নিয়ে 'অসামাজিক কার্যকলাপ' চালিয়ে আসছিলেন। পাপিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদের পর হোটেল ওয়েস্টিনে পাপিয়ার নামে বুক করা সেই সু্যইট এবং ইন্দিরা রোডে তাদের দুটি অ্যাপার্টমেন্টেও অভিযান চালায়র্ যাব। র্ যাব কর্মকর্তারা বলছেন, হোটেল কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কর্মকান্ড চালিয়ে আসা কারও পক্ষেই সম্ভব না। তাছাড়া অনেকের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি ও ভিডিও এখন সোশাল মিডিয়ায় আসছে। এমন এক ভিডিওতে ওয়েস্টিন ঢাকার মূল মালিক নূর আলীকেও পাপিয়াসহ বেশ কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে। কী করেছেন পাপিয়া? :র্ যাব কর্মকর্তাদের ধারণা, মাদক-অস্ত্র চোরাচালান, জমি দখল করিয়ে দেওয়ার মতো কাজের পাশাপাশি ওয়েস্টিন হোটেলে নারীদের দিয়ে 'যৌন বাণিজ্য' চালিয়ে আসছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ এবং সেখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আসত ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের এই নেত্রীর হাতে। র্ যাব-১ এর উপঅধিনায়ক সাফাত জামিল ফাহিম জানান, গত বছরের ১২ অক্টোবর হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেনশিয়াল সু্যইট ভাড়া নেন পাপিয়া। গ্রেপ্তারের সময়ও তার নামেই ছিল ওই সু্যইট, তবে মাঝে বেশ কিছুদিন ছিলেন না। আরও দুটো কক্ষ ভাড়া নেওয়া ছিল পাপিয়ার নামে। ১২ অক্টোবরের পর থেকে মোট ৫১ দিন ওই সু্যইটে থাকার জন্য পাপিয়া ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা বিল মিটিয়েছেন। হোটেলের বার ব্যবহারের জন্য ব্যয় করেছেন এক কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিদিন হোটেল বেয়ারাদের টিপস দিতেন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। র্ যাব কর্মকর্তা ফাহিম বলছেন, পাপিয়া সব সময় বিল মেটাতেন নগদ টাকায়, চেক কিংবা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতেন না। কীভাবে পারলেন পাপিয়া? : পাপিয়ার বিরুদ্ধে করা তিনটি মামলায় ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়ার কর্মকান্ডের বিবরণ দেওয়া হলেও তাতে হোটেল কর্তৃপক্ষের কোনো যোগাযোগ ছিল কি না- সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে এ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু। তিনি লিখেছেন, 'আন্তর্জাতিক চেইন ব্যবস্থাপনার ৫-তারা হোটেলে রুম বুকিং দিতে বিস্তারিত পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হয়। এজেন্সি প্রয়োজনে এসব তথ্য সংগ্রহও করে থাকে। বাইরের সাক্ষাৎকারী সাধারণত লবিতে বসে কথা বলেন, কদাচ রুমে যান। সেখানে ভাড়াটে নারী এনে অনৈতিক কাজ চলল কি হোটেল কর্তৃপক্ষের অজান্তে? পাপিয়ার মামলায় হোটেল কর্তৃপক্ষ কি জবাবদিহিতায় আসবে?' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদও বলছেন, ওয়েস্টিন হোটেল নিয়মের অজুহাত তুলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, 'হোটেলের দায়বদ্ধতা হলো, তাদের কাছে (হোটেলের অতিথি) কে আসবে না আসবে সেগুলো স্ট্রিক্টলি মনিটর করবে। বোর্ডার ছাড়া তো রাতে হোটেলে আর কারও থাকার কথা না। এ ব্যাপারে হোটেল মালিকরা দায় এড়াতে পারে না। বাইরের মানুষ এসেছে, বাইরের মানুষ থেকেছে উইদাউট দেয়ার কনফার্মেশন, এটা অসম্ভব ব্যাপার।' এসব প্রশ্নের উত্তরে ওয়েস্টিনের মার্কেটিং কমিউনিকেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক সাদমান সালাহউদ্দিন বলেন, 'এ ধরনের ঘটনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে। কিন্তু এ ঘটনায় হোটেল দায়ী হতে পারে না। আমাদের গেস্ট এসেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। রুমে যারা আছে, তাদের প্রাইভেসি আছে। এখন কে কোথায় কী করেছে, সেটা দেখার সুযোগ নেই। আমাদের রুমের মধ্যে কোনো ক্যামেরা নেই। ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি না।' পুলিশ এ বিষয়ে কী করছে জানতে চাইলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, 'এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে এখনো আসেনি। অভিযোগ থাকলে আমরা দেখব। এখন বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলার তদন্ত করছে। হোটেলের কেউ দোষী হলে তা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে।'