ডিশ-ইন্টারনেট ব্যবসার বিরোধে ফজলু খুন

দিপুর জবানবন্দি

প্রকাশ | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
গাজীপুরের ফজলু মিয়াকে খুন করতে বস্ন্যাংক চেক দেওয়া হয় ভাড়াটে খুনিদের। খুনের পর নগদ দেওয়া হয় আরও ২ লক্ষ টাকা। ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে পরিকল্পনাকারীরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ছাত্র শাহিনুল ইসলাম দিপুর। সম্প্রতি এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তারের পর তার জবানবন্দিতে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৮ সালের ২৮ মে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের কাজী শিমলা নামের স্থান থেকে মজনু মিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরের দিন মজনুর মা ত্রিশাল থানায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন এবং হত্যা মামলা দায়ের করেন। দুই দফা তদন্তের ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই হত্যা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি। এরপর ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টম্বর হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শাহিদুল ইসলাম দিপুকে গ্রেপ্তার করলে রহস্যজট খোলে এবং হত্যার দ্বায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে ১৬১ ও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। ওই জবানবন্দির কপি যায়যায়দিনের কাছে রক্ষিত রয়েছে। জবানবন্দি সূত্রে জানা গেছে, মামলার প্রধান আসামি শাহিনুল ইসলাম দিপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ'র ছাত্র। বসবাস করে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার বাইমাইল এলাকায়। ওই এলাকায় তার ডিশ ও ইন্টারনেটের ব্যবসা রয়েছে। পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক দলের সাথেও তার ভালো যোগাযোগ। এলাকার বেশির ভাগ উঠতি বয়সি ছেলেরা দিপুর সাথে সরকারদলীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। ২০১৫ সালে ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য উজ্জ্বল নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে মজুন মিয়ার সাথে পরিচয় হয়। মজনু মিয়া দিপুর লাইনম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। এবং বসবাস শুরু করেন দিপুর বাসায়। এরইমাঝে মজনু কাঁচাটাকার লোভে পড়েন এবং স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এতে ক্ষিপ্ত হয় দিপু। এ কারণে মজনু বাসা পরিবর্তন করে অন্যস্থানে বসবাস শুরু করেন। এক পর্যায়ে মজনুও এলাকায় উঠতি বয়সি ছেলেদের নিয়ে আলাদা দল গঠন করেন। একসময় দিপুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন মজনু মিয়া। এলাকায় চাঁদাবাজি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ নেন মজনু। এরপর হাত বাড়ায় দিপুর ব্যবসার দিকে। একসময় দিপুরই লাইনম্যান তার জন্য এলাকায় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এনিয়ে বিরোধের এক পর্যায়ে মজনু হামলা চালায় দিপুর বাসায়। হামলায় দিপুর বাসার অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হয়। ওই হামলার সময় দিপুর বডিগার্ড মোস্তফা ও অফিসের স্টাফ আলামীনকেও বেধড়ক মারপিট করা হয়। দিপু ওই সময় গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এর কয়েকদিনের মাঝে আবারও দিপুর নির্বাচনী অফিসে হামলা ও তার চাচার বাসায় ডাকাতি করে মজনু। এতে দিপুর ধারণা হয় তার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী খোকনের সাথে হাত মিলিয়ে মজনু এসব কর্মকান্ড চালাচ্ছে এবং তাকে যেকোনো সময় খুন করতে পারে। সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, খুন হওয়ার আতঙ্কে দিপু কিছুটা গুটিয়ে যান। এরই মাঝে কোনাবাড়ী বায়োমিল এলাকায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয় দিপুর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী খোকনের সহযোগী কানা দেলু। গ্রেপ্তারের পর দেলুকে রাখা হয় কাশিমপুর জেল খানায়। সেখানে দেলুর সাথে পরিচয় হয় বরিশালের কিলার রফিকের সাথে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলে গেলেও দেলুকে ছাড়িয়ে নিতে কোনো ধরনের তৎপরতা চালায়নি তার একসময়ের সহযোগী খোকন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে খোকনের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী দিপুকে খবর পাঠায় দেলু। খবর পেয়ে দিপু তার বড় ভাই জিকুকে সাথে নিয়ে দেলুর সাখে জেলখানায় দেখা করেন। সেখানে কিলার রফিকের সাথে দিপুর পরিচয় করিয়ে দেয় দেলু। সেখানে কথা বলার এক পর্যায়ে রফিক ও দেলুকে বের করিয়ে আনতে রাজি হয় দিপু। এরপর পরিকল্পনা শেষে দেলু ও রফিককে কিছু হাত খরচের টাকা দিয়ে তারা চলে আসে। কয়েকদিন পর কিলার রফিক ছাড়া পেয়ে দিপুর সাথে দেখা করে। তখন দিপু তাকে কাজে লাগানোর আশ্বাস দেয়। এরপর রফিককে কয়েক হাজার টাকা দিলে সে গ্রামের বাড়ি বরিশালে চলে যায়। বরিশালে গিয়ে কিলার রফিক যোগাযোগ করেন আরেক কিলার বায়েজিদের সাথে। এরপর দিপুকে বরিশালে ডেকে পাঠায় রফিক। কয়েকদিন পর বরিশালে যায় দিপু। সেখানে যাওয়ার পর তারা একটি হোটেলে ওঠেন। এরপর সেখানে খুলনার কিলার মিঠুন ও সাগরদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। পরেরদিন তারা দিপুকে সাথে নিয়ে সুন্দরবন এলাকার একটি নির্জনস্থানে যায়। সেখানে আরও কয়েকজন কিলার জড়ো হয়। এক পর্যায়ে ওই ভাড়াটে খুনিদের সাথে দিপুর একটি চুক্তি হয়। চুক্তিমতে, তার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী খোকন ও মজনু মিয়াকে খুন করার জন্য একটি বস্ন্যাংক চেক ও নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এরপর দিপু গাজীপুরে চলে আসে। এরইমাঝে কিলার গ্রম্নপের সদস্য মিঠুন ফোন করে খোকনকে। বলা হয় তাকে খুন করার জন্য বস্ন্যাংক চেক ও ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে দিপু। এখন বাঁচতে চাইলে খোকন তাদের কত টাকা দিবে এটাও জানতে চাওয়া হয়। খোকন বিশ্বাস না করলে তার মোবাইল ফোনে কিছু ছবি পাঠানো হয়। এরপর খোকন বিশ্বাস করে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের টাকা না দিয়ে সে সাবধান হয়ে যায় এবং কিলারদের ফোন এড়িয়ে চলে। এরপর মজনু খুনের দুই থেকে তিন দিন আগে রফিক, মিঠুন ও সাগরসহ আরও ৩ থেকে ৪ খুনি গাজীপুরে অবস্থান নেয়। সেখানে আরেকদফা পরিকল্পনার পর ২৪ মে রাত ১১টার দিকে মীমাংসার কথা বলে মজনুকে মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে নেয় দিপু। এরপর তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে বেধড়ক পিটিয়ে জখমের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে অজ্ঞাত হিসাবে লাশ উদ্ধার করে ত্রিশাল থানা পুলিশ। এরপর ২৯ মে মজনুর মা আজুফা বেগম লাশ শনাক্ত করেন। মজনুকে খুন করার পর কিলারদের আরও ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। তারা ঘটনার পর নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যান। সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ২৪ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত মজনু নিখোঁজ থাকার সময় দিপুর সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে মজনুর বাবা-মা। এসময় তাদের নানাভাবে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে মামলার আসামি শফিকুল ইসলাম শফি শেরপুর জেলার এক আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে পিটিশন অপহরণ মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় সাক্ষী করা হয় দিপুকে। আদালত এটি তদন্তের নির্দেশ দিলে তার সত্যতা না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এরপর থানায় দায়ের করা মামলার সূত্র ধরে খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন ও আসামি গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও সিআইডির প্রধান চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন বলেন, হত্যাকান্ডটি ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য আসামিরা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল পরিকল্পনাকারীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখন বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলে দ্রম্নতই এই মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া সম্ভব হবে।