'করোনায় নয়, না খাইয়াই মইরা যামু'

প্রকাশ | ২৯ মার্চ ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রিকশাচালক আরশ আলী
'আমার ঘরে তো খাবার লাগবে। বউ আছে, বাচ্চা আছে, আমি আছি। রোগে মরা লাগবে না, না খাইয়াই মইরা যামু। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪০ টাকা আয় হয়েছে।' আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক আরশ আলী। তিনি থাকেন খুলনা মহানগরের পাঁচ নম্বর ঘাট এলাকায়। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অঘোষিত লকডাউনের জেরে সড়কে জনমানব না থাকায় আয় শূন্যের কোঠায় চলে গেছে। গত শুক্রবার মহানগরের শিববাড়ির মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক আরশ আলীর সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, 'প্রশাসনের লোকজন রাস্তায় নামলে বাধা দেয়। যে বাড়ি থাহি, তাগের কইছি করোনাভাইরাস না যাওয়া পর্যন্ত ঘর ভাড়া দিতে পারমু না। পরে শাশুড়ির কাছ থেকে এনে ভাড়া দিয়েছি। রিকশার মহাজনরে কইছি, করোনা না গেলে ভাড়া দিতে পারমু না।' পাশে রিকশা নিয়ে দাঁড়ানো ফুলমিয়া বলেন, 'ঘরে বইসে থাকলে তো কেউ আমাগে খাবার দেবে না। আমাদের কর্ম তো এই রিকশায়। পুলিশ আমাদের রাস্তায় নামতে নিষেধ করছে। আমরা তাদের কইছি, আমরা যদি ঘরে বসে থাহি তাহলে আমাগে তো কেউ খাবার দিয়ে যাবে না। আমাগে বাচ্চা আছে। রিকশা চালানো ছাড়া তো আর কিছু করি না।' মহানগরের বসুপাড়া এলাকায় ষাটোর্ধ্ব অপর এক রিকশাচালক রমজান আলী বলেন, 'মার্কেট বন্ধ। মুদির দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতাশূন্য। কোনো গাড়ি চলছে না। মানুষ বাইরে বের হচ্ছে না। গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন মানুষ। কোনো ভাড়া পাই না। অথচ চাল-ডাল, শাকসবজি ও মাছ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সংসার চালাতে পারছি না। কেউ কোনো সাহায্যও করছে না।' তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলাও খেতে পারছি না প্রায় কেঁদেই ফেললেন রমজান আলী। তিনি বলেন, 'চাল-ডাল দেয়ার কোনো খোঁজ নেই। শুধু সচেতন হইতে বলে। এ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমরা যারা না খেয়ে আছি। কেউ এসে দু'বেলা খোঁজ নিল না। কি খেলাম, না খেলাম। শুধু মুখ বাঁধতে কয়।' একাধিক রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের মাথায় এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খুলনা নগরের ৩১টি ওয়ার্ডে ছোটবড় মিলিয়ে বস্তির সংখ্যা ৭২৬টি। এতে বসবাস করছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। এর মধ্যে লক্ষাধিক রয়েছেন রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইকচালক। হতদরিদ্র মানুষরা জানান, পেটের জ্বালায় তাদের বাইরে বের হতে হয়। অনেক সময় পুলিশ তাদের অযথা হয়রানি করে। নিরাপদ পোশাক, মাস্ক, হ্যান্ড গস্নাভস পরতে বলেন। গত বুধবার সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর মহানগরের রাস্তাঘাট একদম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা মাঠে থাকায় কেউ সাহস করে বাইরে বের হচ্ছেন না। শহরের প্রাণকেন্দ্র রয়্যালের মোড় কিংবা শিববাড়ি মোড়ে দাঁড়ালে মনে হবে অন্য কোনো শহরে দাঁড়িয়ে আছি। চিরচেনা সেই যানজট ও ফুটপাতে ব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা একদম নেই। গলিগুলোতে যাত্রীদের আশায় হাতেগোনা কয়েকটি রিকশাচালক হাঁকডাক দিচ্ছেন যাত্রীর আশায়। কিন্তু সড়কগুলো ফাঁকা ময়দানে পরিণত হয়েছে। বিপুল পরিমাণে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্কে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মানুষ। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার, পরিবহণ শ্রমিক ও দোকান কর্মচারী সবারই একই অবস্থা। মাসের শেষে এসে এই সংকট শুরু হয়েছে। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে, অন্যদিকে স্বচ্ছল লোকজন বাসায় খাদ্য মজুদ করেছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনা জেলা কমিটির সম্পাদক অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, 'আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ লোক যারা দিন আনে দিন খায়। তাদের শুধু ঘরে পাঠিয়ে দিলেই হবে না। তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুধার জ্বালায় চুরি-ডাকাতি বেড়ে যাবে। করোনা সংক্রমণের এই সময় রিকশাচালকসহ দিনমজুর দরিদ্র মানুষরা সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন। অতি দ্রম্নত এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেয়া শুরু করা উচিত। দেশে সরকারি ও বেসরকারি গুদামগুলোয় পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে।' 'সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দ্রম্নত খাদ্য সহায়তা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া এখন সময়ের দাবি।' তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'সিটি করপোরেশনের ৩১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এমনকি উপজেলা পর্যায়ের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। শুধু ঘরে থাকলেই সমস্যার সমাধান হবে না।' শ্রমজীবী, গরিব-দুঃখী, খেটে খাওয়া মানুষের পাশে সমাজের জনপ্রতিনিধি ও বিত্তবানদের অতিদ্রম্নত দাঁড়ানোর আহ্বান জানান কুদরত-ই-খুদা।