পিপিই মানসম্পন্ন না হলে ডেকে আনবে বিপদ

প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
করোনাভাইরাস থেকে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য রাজধানীর একটি পোশাক কারখানায় পিপিই তৈরির কাজে ব্যস্ত পোশাকশ্রমিকরা -ফাইল ছবি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, কোভিড ১৯-এর রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের পরিধান করতে হবে বিশেষ পার্সোনাল প্রটেকশন ইকু্যইপমেন্ট। তবে এটি হতে হবে রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধযোগ্য (কেমিক্যাল হ্যাজার্ড প্রিভেন্টেবল)। এছাড়া এই পোশাক হতে হবে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এবং স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের উপযোগী। এই পোশাক হবে কম্বো পিপিই-কাভারঅল, হেডমাস্ক, গগলস, বুট এবং সুকাভারসহ। এগুলো হবে ডিসপোজেবল, একবার পরার পর ফেলে দিতে হবে। যদিও চিকিৎসক, রোগীর কক্ষে থাকা স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ প্রতিটি স্তরের পেশাজীবীদের জন্য পৃথক পৃথক পিপিইর কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্বখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক পিপিই রিজেক্ট করা হয়েছে কেবলমাত্র স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন না হওয়ার কারণে। অথচ দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে একাধিক ব্যক্তি, সামাজিক সংগঠন পিপিই তৈরি করছে। কেউ করছে বাণিজ্যিক কারণে, কেউবা আবার স্বেচ্ছায় সহযোগিতা করার জন্য। কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড এবং সাম্প্রতিক সময়ে চীনেও একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, এ তিন স্ট্যান্ডার্ডের ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ হলেই কেবলমাত্র একটি পারফেক্ট পিপিই তৈরি করা সম্ভব। এটাতো ভাইরাস, এ কারণে এ মুহূর্তে এর পিপিই কেন সবকিছুর চেয়ে আলাদা সেটা বুঝতে হবে। এই পিপিই ওয়াটারপ্রম্নফ হতে হবে, ভাইরাস প্রটেক্ট করবে একই সঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে পারার সুযোগ থাকতে হবে। তারা বলছেন, দেশে পিপিই নিয়ে ব্যবসা শুরু হওয়া জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আর যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পিপিই পরা মানে কোভিড ১৯-কে ছড়িয়ে দেওয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতোমধ্যে এ বিষয়ে যে লজিস্টিক সাপোর্ট বিষয়ক কমিটি করেছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে স্ট্যান্ডার্ড পিপিইর জন্য নির্দেশনা চেয়েছে এবং সে নির্দেশনা না মানতে পারলে অধিদপ্তর সে বিষয়ে কাউকে অনুমোদন দেবে না বলেও জানিয়েছে কমিটি। কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, বিভিন্ন জন পিপিইর অনুমোদন চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করছে, কিন্তু যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড না মানা হলে আমরা অনুমোদন দিতে পারি না। কমিটির একাধিক সদস্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, এখন বাংলাদেশে অনেকেই শার্টের কাপড়, ছাতার কাপড় দিয়ে পিপিই বানিয়ে বিতরণ করছে, অথচ এটা যে পিপিই না থাকার চেয়েও কতটা ভয়ংকর হতে পারে সে বিষয়ে কেউ নজর দিচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত পোশাক নীতিমালাতে বলা হয়েছে, পিপিই হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষ পোশাক। এর ভেতরে রয়েছে মেডিকেল মাস্ক, গাউন, গগলস, ফেস শিল্ড, হেভি ডিউটি গস্নাভস ও বুট। পিপিই ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক নামের একটি ফেসবুক গ্রম্নপ থেকে পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পেশাজীবীর কাছে। সে গ্রম্নপেরই একজন সদস্য কাজী মনির হোসেন। মনির হোসেন জানান, তারা কেবলমাত্র ওপরের সু্যটটা দিচ্ছেন, যেটি তৈরি হচ্ছে তার নিজের কারখানাতে। তাদের পিপিই স্ট্যান্ডার্ড মানের কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তৈরি করা পিপিই যথেষ্ট স্ট্যান্ডার্ড, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রসিডিউর মেইনটেইন করেছি, যদিও আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন আনতে যাইনি। কেন অনুমোদন নিতে যাননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারণ আমাদের খুব কম সংখ্যক বানানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে 'আইইডিসিআর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিজেদেরও এটা নিয়ে কোনো ধারণা নেই'- দাবি করেন মনির হোসেন। প্রশ্নের মুখে পড়ে তিনি বলেন, তারা যোগাযোগ করেছেন। তবে কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন জানতে চাইলে তিনি কারও নাম বলেননি। চিকিৎসকদের জন্য নয়, তাদের পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সচালক এবং হাসপাতালের স্টাফদের জন্য, এমন কথাও বলেন তিনি। কিন্তু একজন চিকিৎসকের যেমন সঠিক পিপিই দরকার, ঠিক তেমনি একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক বা হাসপাতালের স্টাফেরও সঠিক পিপিই প্রয়োজন। কারণ, একজন আক্রান্ত রোগীর মাধ্যমে তারাও আক্রান্ত হতে পারেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা তো সবকিছু দিতে পারব না, এটা কাইন্ড অব সান্ত্বনা'। এমন গুরুতর ক্ষেত্রে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো পোশাক বিতরণ ঠিক হচ্ছে কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা প্রতিটি পিপিইর সঙ্গে প্রিন্টআউট করে দিয়ে দিচ্ছি যে, পিপিই কী করে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু, গ্রামের স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক অথবা কোনো হাসপাতালের ক্লিনার এতটা সচেতন কি না এবং তাকে এ ধরনের পিপিই দেওয়া ঠিক হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, 'কেন দেব না? আমরা ধরেই নিয়েছি আমাদের পিপিই যারা পরবেন তারা সচেতন।' সবাই সচেতন নয় এবং আপনাদের সরবরাহ করা পিপিই পরলে সুরক্ষার বদলে বিপদ বাড়াতে পারে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'বিপদ বাড়াবে নাকি বাড়াবে না- এটা আসলে কনফিউজিং।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লজিস্টিক সাপোর্ট বিষয়ক কমিটি ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে স্ট্যান্ডার্ড পিপিইর জন্য নির্দেশনা চেয়েছে এবং সে নির্দেশনা না মানতে পারলে অধিদপ্তর সে বিষয়ে কাউকে অনুমোদন দেবে না বলেও জানিয়েছে কমিটি। কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, 'এখন এটি একটি ব্যবসা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আমাদের অনুমোদন নিতে হবে সবটুকু স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে।' এই কমিটির আরেক সদস্য ডা. শামীম রিজওয়ান বলেন, এই পিপিইর স্পেসিফিকেশনের তোয়াক্কা না করে, গুণগত মান নিশ্চিত না করে পিপিই বানানোর হিড়িক পড়েছে দেশে। অথচ এখন রেইনকোটকেও পিপিই বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জেনেরিকভাবে কোনো পোশাককে পিপিই বলে ছেড়ে দেওয়া যাবে না মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, আর যখন এর নাম হবে পিপিই, তখন সবাই কনফিডেন্ট হয়ে যাবে, মানুষ সে পিপিই পরে যখন কোনো কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর কাছে যাবে, তখন সে নিজে আক্রান্ত হবে এবং অন্যকে আক্রান্ত করবে, এর চেয়ে ভয়ংকর আমাদের জন্য আর কিছু হতে পারে না, বলেন ডা. শামীম রিজওয়ান। কোভিড-১৯ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রায় ১৫টি বিভাগের সমন্বয়ে গঠন করেছে সমন্বিত কন্ট্রোল রুম। গত ২৬ মার্চ মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভবনের নিচতলায় কন্ট্রোল রুমে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পিপিইর স্তূপ জমে আছে। অথচ সেগুলো কোনোটাই মানসম্পন্ন এবং নির্ধারিত গুণগত মানের নয়। জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের বিত্তবান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জাতীয় দুর্যোগকে ইসু্য করে পিপিই বানিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু, কোনো জাতীয় দুর্যোগকে ব্যবহার করে এই দুর্বৃত্তায়ন জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। পিপিইর মতো একটি সেনসিটিভ বিষয়ের মেডিকেল ইকু্যইপমেন্ট বানানো কি এতই সহজ- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাহলে পৃথিবীজুড়ে কেন এই পিপিইর সংকট? সাহায্য করা মানে তো কেবল পিপিই দেওয়া নয়, আর তারা আসলে সাহায্যও করছে না। তারা ফটোসেশন, ব্যবসা, সর্বোচ্চ মহলের নজর কাড়া আর ফিউচারের ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে এসব কাজ করছে। তার মন্তব্য, এতে করে উল্টো সমস্যা হচ্ছে। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বা দায়িত্বপ্রাপ্তদের পিপিই নিয়ে সংকট নেই- এমন কথায় আমাদের গেস্নাবাল যেসব পার্টনার রয়েছে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা মনে করছে, আমাদের পিপিই প্রচুর রয়েছে, যেটা একেবারেই বিভ্রান্তিমূলক। তাই ব্যবসা এবং সহযোগিতার নামে এমন ফটোসেশন বন্ধ করতে অবিলম্বে নজর দিতে হবে বলেন ডা. ইকবাল আর্সলান।