পর্যটন ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

দেশের পাঁচ হাজার ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রায় ৫০ হাজার কর্মচারী কাজ করেন। এছাড়া মধ্যস্থতাকারী এবং দালালসহ কমপক্ষে পাঁচ লাখ লোক এই খাতে জড়িত। করোনার কারণে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে

প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
চট্টগ্রামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি মাহিম ওভারসিজ। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের কাছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার শতাধিক টিকিট বিক্রি করে। এখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংকটের কারণে ১৬ মার্চ থেকে তাদের ব্যবসা শূন্যের কোঠায়। এজেন্সিটির ১০ জন কর্মচারীসহ সারাদেশে আরও অনেকেই এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) তথ্যনুসারে, দেশের পাঁচ হাজার ট্র্যাভেল এজেন্সিতে ৫০ হাজার কর্মচারী কাজ করেন। এ ছাড়াও মধ্যস্থতাকারী এবং দালালসহ কমপক্ষে পাঁচ লাখ লোক এই খাতে জড়িত। করোনার কারণে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আটাব চট্টগ্রামের সভাপতি মো. আবু জাফর যায়যায়দিনকে বলেন, ১৫ মার্চ বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিমান চলাচল বন্ধ হওয়ার পর থেকে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আটাব সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকার পণ্য ও পরিষেবা বিক্রি করে। প্রতিদিন তাদের সেবামূল্য ১৩৭ কোটি টাকা। তবে বিশ্বজড়ে করোনাভাইরাসের কারণে এই এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সির চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়ের মধ্যে লোকজন কোনো গন্তব্যে ভ্রমণে আগ্রহী না হওয়ায় তারা যে সমস্ত ভ্রমণ প্যাকেজ সরবরাহ করতেন, তা বাতিল করা হয়েছে। তারা পর্যটন, হজ বা অন্য কোনো প্যাকেজের জন্য বিমানের টিকিট বিক্রি করতে পারছেন না। মাহিম ওভারসিসের রিজার্ভেশন ম্যানেজার তানভীর মেহেদী জানিয়েছেন, তার এজেন্সিকে গত সপ্তাহে ২০০টি টিকিট ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বর্তমানে তাদের টিকিটের বিক্রি শূন্যে নেমে গেছে। মেন্টেনেইন্স খরচ এবং বেতন পরিশোধে তারা এজেন্সি চালাতে পারবেন কিনা, তা জানেন না। এর আগে কখনো এ জাতীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি তারা। করোনার কারণে চট্টগ্রামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি 'ফ্লাই টুডে' বন্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের সাত কর্মচারী এখন বেকার। এজেন্সিটির মালিক আহমেদ রুবেল বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠান চালাতে পারছিলেন না, এ জন্য সংস্থাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আন্তর্জাতিক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শামীম চৌধুরী নোমান যায়যায়দিনকে বলেন, বিদেশে কর্মী প্রেরণ এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে এবং কখন এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তা তারা জানেন না। শামীম বলেন, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে সাত লাখ ১১ হাজার মানুষকে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করেছিলেন। এ বছর ৯ মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ অভিবাসিত হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্মচারী বলেন, তিনি এখনো ফেব্রম্নয়ারির মাসের জন্য বেতন পাননি। এখন তিনি চাকরি হারানোর শঙ্কায় আছেন। এদিকে, টু্যর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। দেশে বিদেশে ভ্রমণের সব বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। যেকোনো দুর্যোগে সর্বপ্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন খাত। চীনে গত নভেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। চীনের পর সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত দেশে পর্যটনের ভরা মৌসুম ডিসেম্বর-ফেব্রম্নয়ারি। এ সময় আবহাওয়া অনুকূলে থাকার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। তাই বিদেশ থেকে অনেকে এ সময় বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অনেকে বেড়াতে যান। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এবার ভরা মৌসুমে তাদের ব্যবসায় ধস নেমেছে। বর্তমানে ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন আতঙ্কে বের হচ্ছেন না। আবার ভ্রমণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে অনেক দেশ। সে কারণে পর্যটকরা পূর্বনির্ধারিত সব বুকিং বাতিল করেছে। করোনার কারণে সব টু্যর অপারেটররা পঙ্গু হয়ে গেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ পর্যটনও তাদের ব্যবসার একটা বড় অংশ। দেশে অঘোষিত লকডাউন চলায় এবং সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় সেখানেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশে যাওয়া এবং বাংলাদেশে আসা বুকিংয়ের শতভাগ বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বুকিং বাতিল হচ্ছে। টু্যর অপারেটররা একটি প্যাকেজের মধ্যে উড়োজাহাজের টিকিট, হোটেল-মোটেল, গাইড, যাতায়াত, দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করে দেন। বুকিং বাতিল হওয়ায় সবাই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সৌদি এয়ারলাইন্সসহ হাতেগোনা কয়েকটি বিমান সংস্থা টিকিট বাতিলের পরও রিফান্ড ফি নিচ্ছে না। বাকি বিমান সংস্থাগুলো মাশুল নিচ্ছে। তাই টু্যর অপারেটররা গ্রাহকদের বুকিং বাতিল না করে আপাতত স্থগিত করার অনুরোধ করছে। তবে গ্রাহকরা এতে সায় দিচ্ছেন না, সরাসরি বুকিং বাতিল করছেন। এতে অনেক টু্যর অপারেটকেই লোকসান গুনে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে। টোয়াব সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রভাবে পর্যটন খাতের ভরা মৌসুমেও ব্যবসা করতে পারেনি তারা। সে জন্য তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ২৫-৩০ শতাংশ কর্মীকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অবসরে পাঠাবেন। তবে মানবিক কারণে তারা সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছেন। ইতোমধ্যে তারা সদস্যদের আগামী দুই মাস কোনো কর্মী ছাঁটাই না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রয়োজনে ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে হলেও কর্মীদের বেতন নিয়মিত পরিশোধ করতে উদ্যোক্তাদের বলা হয়েছে। এরপরও যদি করোনা অব্যাহত থাকে, তাহলে তারা টিকে থাকতে পারবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টু্যর অপারেটররা কোনো ধরনের পরিবেশদূষণ ছাড়াই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে খাতটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি প্রণোদনা দরকার। সেটি সম্ভব না হলে সহজ শর্তে বিনা সুদে ঋণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ ছাড়া অগ্রিম আয়কর ও সিভিল এভিয়েশনের বার্ষিক ফি মওকুফ করে দিলে উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। ৮০ শতাংশ প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরও করোনার কারণে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী পিছিয়ে দিয়েছে তারা। এতে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে টোয়াব। ভবিষ্যতে সেই প্রদর্শনী সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সরকারের আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।