না'গঞ্জে করোনা শনাক্তে উদাসীন স্থানীয় প্রশাসন

প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

হাসান আরিফ
বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাস নিয়ে সরকার যতটা সতর্ক, স্থানীয় প্রশাসন ততটাই উদাসীন। রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার পরও স্থানীয় পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। নেই কোনো সমন্বয়। সম্ভাব্য রোগী চিহ্নিত হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সিভিল সার্জন, এমনকি সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুমেও জানানো হয়েছে। তারাও কোনো উদ্যোগ নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে ওই এলাকার বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের ডনচেম্বার এলাকায় কামরুজ্জামান রতন নামে এক লোক পাঁচ দিন ধরে ঠান্ডা, কাশি, গলাব্যথা আর জ্বরে আক্রান্ত। পরিবারের সদস্যদের ধারণা, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এলাকাবাসীও তাই ধারণা করছে। পরিবার এবং এলাকাবাসী নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে কোনো প্রতিকার পায়নি। তাই গত বুধবার স্থানীয় এক সাংবাদিককে বিষয়টি জানান কামরুজ্জামান রতনের কয়েক জন সুহৃদ ও বন্ধু। ওই সাংবাদিক ওইদিনই বিষয়টি জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনকে জানান এবং রোগীর নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে দেন। একই দিন দুপুরে জেলা প্রশাসনের করোনাবিষয়ক কন্ট্রোল রুমে কল করে ওই সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত সন্দেহের লোকের নাম-ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দেন এবং একই ভবনে কদিন আগে এক প্রবাসী এসেছেন তাও কন্ট্রোল রুমকে জানান। কন্ট্রোল রুম রোগীর নাম-ঠিকানার পাশাপাশি সাংবাদিকের নাম-ঠিকানাও নেন এবং তাকে জানানো হয় তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ডিসিও একইভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন। জানা যায়, ডিসি, সিভিল সার্জন এবং কন্ট্রোল রুমে জানানোর ৩০ ঘণ্টায়ও জেলা প্রশাসন থেকে আক্রান্তের কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি। পরে বিষয়টি জানার জন্য বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনকে কল করা  হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। ডিসি কল রিসিভ না করায়, জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে ফোন করে জানতে চাওয়া হলে, বলা হয় আমাদের ডিউটি চেঞ্জ হয়। তাই এখন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন না। একই সঙ্গে তিনি জানান, এই কন্ট্রোল রুম খাদ্য সামগ্রীর বিষয়ের। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহের জন্য নয়। এজন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করুন। তখন তিনি আলাদা দুটি কন্ট্রোল রুমের মোবাইল নম্বর দেন। জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুমে কল করে এক সেনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন। তিনি আক্রান্তের সম্পর্কে জেনে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে ডা. জাহিদ নামে এক চিকিৎসক করোনার বিষয়ে দেখে থাকেন বলে তিনি জানান। সেনা চিকিৎসক রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেও জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর রোগীকে বাসা থেকে বের না করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। তারা রোগী কোন পরিবহণও ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছেন। আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, কারো জ্বর, সর্দি, কাশি হলেই করোনা আক্রান্ত বলে মনে করার কারণ নেই। বিদেশফেরত হলে বা এরকম কারও সংস্পর্শে এলে এবং লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতালে যাওয়া বা আইইডিসিআরে আসার কোনো দরকার নেই, বরং হটলাইনে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়া যাবে। প্রয়োজনে আইইডিসিআরের প্রতিনিধিদল গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে আসবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির জেলার স্টাফ রিপোর্টার নাফিজ আশরাফ বলেন, ডা. জাহিদ এবং ভিক্টোরিয়ায় হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা সম্পর্কে সাংবাদিকদের কখনো জানাননি জেলা প্রশাসন। বরং নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, কোথাও কোনো সন্দেহ ভাজন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলে তারাই নিজ উদ্যোগে রোগীর বাসায় যাবেন এবং রোগীর নমুনা সংগ্রহ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন দেখা গেল। ডনচেম্বার এলাকার বাসিন্দা আক্তার হোসেন মুকুল বলেন, তারা চরম আতঙ্কে আছেন। এ বাসার সবাই যেমন আতঙ্কে আছেন, একইভাবে পুরো এলাকার মানুষও আতঙ্কিত। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। উপায় না পেয়ে সাংবাদিকদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এখনো এ রোগীকে দেখার জন্য চিকিৎসক বা প্রশাসনের কেউ আসেনি। অসুস্থ কামরুজ্জামান রতনের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের স্বজন করোনা আক্রান্ত কি না তারা নিশ্চিত না। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য তারা সবার সাথেই যোগাযোগ করছেন। কিন্তু কারো থেকেই সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তাদের ভাষ্য, তাদের স্বজন যদি আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে যত বিলম্ব হবে ততই তার এবং পরিবারের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। আর চিকিৎসা শুরু করা না গেলে তিনি ভালোই বা হবেন কি করে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে যারা দেশে ফিরেছেন, কিন্তু তার মধ্যে কেউ সংক্রমণ নিয়ে দেশে ঢুকছেন কিনা, সরকারের তা জানা নেই। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের শনাক্ত করার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে এই দায়িত্ব সেনাবাহিনী পালন করছে। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, যে পরিমাণ বাংলাদেশি বিদেশ থেকে ফিরছেন- তার মধ্যে অতি নগন্যসংখ্যককে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে অনেকেই পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে কিনা - বিশেষজ্ঞরা সেই প্রশ্ন তুলছেন। করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আসা মানুষ এবং তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের মধ্যেই নমুনা পরীক্ষা সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই সরকারের জানার বাইরে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরই পরীক্ষা করা হয় এবং সেজন্য সংখ্যাটা কম দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে এতে একটা ঝুঁকি দেখছেন। তারা মনে করছেন, ১৬ কোটির বেশি মানুষের এই দেশে এখন ভিতরেই সংক্রমণ হচ্ছে কি না সেটাও জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।