জেলেদের চোখে জল, সংসার অচল

খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার জেলেদের কাছে যথাসময়ে খাদ্যসহায়তা না পৌঁছানোর কারণে লক্ষাধিক জেলে পরিবারের কাটছে মানবেতর জীবন

প্রকাশ | ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশে মাছ ও আমিষের চাহিদা পূরণ করেন এই জেলেরা। করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের চোখে মুখে শুধুই হতাশা। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে -যাযাদি
'ছাবাল (ছেলে) ম্যায়ি (মেয়ে) নিয়ে না খাইয়ে আছি, ভালো কুরি (করে) কেউ শোনে না আমাগে কথা। নদীতে মাছ ধরতে গেছিলাম। কোস্টগার্ড বাধা দেয়। চুলি (চলে) আইছি। সরকারের নিষেধে মাছ ধরতি পারি না। শরীল গতরও ভালো না। গ্রামে কোনো কামও নাই।' খুলনা জেলার সর্বদক্ষিণে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এবং উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মাটিয়াভাঙ্গা গ্রামের জেলে আইয়ুব আলী আক্ষেপ করে এ কথাগুলো বলেছিলেন। জেলে আইয়ুব আলী জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে তাদের কাছে তিনবেলা খাবার খেয়ে জীবন বাঁচানোটাই এখন দায় হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন তারা সুন্দরবন-সংলগ্ন নদীতে মাছ ধরতে পারছেন না। নদীতে থাকার কারণে তারা কোনো রাজনীতি করারও সুযোগ পান না। যে কারণে নেতাদের কোনো সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম ও চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে কর্মজীবী মানুষ। বিশেষ করে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছে উপকূলীয় জেলেপলিস্নর জেলেরা। সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তারা। সব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যথাসময়ে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার জেলের কাছে খাদ্যসহায়তা না পৌঁছানোর কারণে লক্ষাধিক জেলে পরিবারে কাটছে মানবেতর জীবন। জেলেরা জানান, অন্য পেশার মানুষ ১২ মাস আয় করতে পারে। কিন্তু বছরে কয়েক দফা মাছ শিকার নিষেধাজ্ঞা থাকে জেলেদের। মাঝেমধ্যে পেটের দায়ে কেউ মাছ ধরতে নামলে ভ্রাম্যমাণ আদালত আটক করে জেল-জরিমানা, জাল-নৌকা জব্দ করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেক জেলে। এর কারণে এখন করোনার এই সময়ে কেউ ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে নামছে না। খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ড ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বেলাল হোসেন বলেন, আমাদের ইউপিতে মোট ৫২০০ পরিবার আছে। এদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা সাধারণ সহায়তার (জিআর) চাল দুই টন ১৬২ কেজি বরাদ্দ হয়েছে। প্রতি পরিবারের জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ রয়েছে। তাতে ২৪৬ পরিবার চাল পান। কিন্তু শুধু ইউনিয়নে ৩৯৫৭ পরিবার জেলে। বিশাল এ জেলে পরিবারকে কোনো জিআর চালসহ সরকারি সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা দসু্য, সবকিছুই মোকাবিলা করে সুন্দরবন-সংলগ্ন নদ-নদীতে এসব জেলে মাছ শিকার করে থাকে। জীবিকার জন্য জীবন বাজি রেখে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক সময় তাদের অথৈ সাগরে যেতে হয় মাছ শিকারে। বর্তমানে করোনার কারণে তারা কাজে যেতে পারছেন না। এর কারণে তিন বেলা খাবারও জুটছে না এসব কর্মহীন জেলের। বটিয়াঘাটার জলমা গ্রামের এক মাছ শিকারি শিমুল বলেন, পরিবার নিয়ে এখন বেঁচে থাকায় কষ্টের হয়ে গেছে। নদীতে মাছ ধরতে দিচ্ছে না। গ্রামেও কোনো কাজ নেই। দুই মুঠো ভাতের জোগাড় করতেই পারছি না। সুন্দরবনের জয়মনির ঠোটার জেলেপলিস্নর জেলে আব্দুলস্নাহ বলেন, এহন আমাগো খারাপ দিন। নদীতে মাছ ধরতে দেয় না। মাইয়ে, পোলা নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। মাছের উপর সংসার চলে। তিনি আরও বলেন, এই পলিস্নতে স্থায়ী প্রায় ৫ হাজার মানুষ থাকে। অন্যান্য এলাকা থেকে মাছের মৌসুমে আরও ৫ হাজার মানুষ আসে। মাছ ধরি বদ্দর, হরিণটানা, আন্ধাররা, মাইডা থেকে। এখন কোথাও মাছ ধরতে দেয় না। তাই জাল, দড়ি, লগি, বৈঠা, নৌকা ঠিক করে সময় কাটছে। মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের সিন্দুরতলা এলাকার জেলে অরেবিন্দু রায় বলেন, এমনি তে তো কোনো পোনা ধরতে দিচ্ছিল না কয়েক মাস ধরে। কিছু সাদা মাছ ধরে সংসার চালাতাম তাও এখন বন্ধ। তিনি বলেন, তাদের গ্রামে প্রায় ৩০০ মৎস্যজীবী রয়েছে। করোনার কারণে সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। যাদের অনেকের চুলা এখন জ্বলছে না। খুলনার কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, বাগেরহাটের মোংলা, রামপাল, শরণখোলা মোড়েলগঞ্জ, সাতক্ষীরার তালা, আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লক্ষাধিক জেলে-মাঝির এভাবেই দুর্বিষহ জীবন চলছে। মাছ ধরতে পারছেন না। যে কারণে অনেকের চুলাইও জ্বলছে না। বাগেরহাট উপকূলী মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি শেখ ইদ্রিস আলী বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে জনসমাগম ও চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞারোপ করার পর থেকে কোনো জেলে নদ-নদী, খাল-বিল এমনকি সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না। এতে কর্মীহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার জেলে পরিবার। তিনি বলেন, কেবল বাগেরহাটেই ৩০ হাজারেরও অধিক জেলে রয়েছে। যারা বর্তমানে কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব জেলে পাচ্ছে না কোনো সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা। তিনি অভিযোগ করেন, জেলেদের দুর্বিষহ কথা জানানোর জন্য মৎস্য অধিদপ্তরে বারবার যোগাযোগ করা হলে কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি।