করোনায় পোশাকশিল্পে অশনিসংকেত

প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
কারখানায় কর্মরত নারীশ্রমিক
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার যত বাড়ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগও ততটাই ঘনীভূত হচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে এরই মধ্যে সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এই শিল্প টিকে আছে ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সেসব দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে বহু পশ্চিমা ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্ডার বাতিল কিংবা স্থগিত করছেন। ঢাকার পাশে টঙ্গিতে একটি গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন সাবিনা আক্তার। তিনি যে কারখানায় কাজ করেন সেখানে প্রায় ৮০০'র মতো শ্রমিক আছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের কারখানা টালমাটাল অবস্থা চলছে। মালিকপক্ষ জানিয়েছে তাদের হাতে আপাতত কোনো অর্ডার নেই। ফলে কারখানা আপাতত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে আটকে গেছে শ্রমিকদের বেতন। এই অবস্থা থেকে কবে মুক্তি মিলবে সেটি ভেবে এখন দুশ্চিন্তায় আছেন সাবিনা আক্তার। তিনি বলেন, 'আজকের খাবারটা আমার আছে। কালকেরটা কোথায় পাবো বলতে পারি না'। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন ইউরোপ-আমেরিকা বিপর্যস্ত। প্রতিদিনই হাজার-হাজার মানুষ এই ভাইরাস সংক্রমণে মারা যাচ্ছে। আক্রান্তের হারও বাড়ছে বেশ অবিশ্বাস্য গতিতে। এমন অবস্থায় সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপ আর আমেরিকা। স্বভাবতই এটি পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে। সে লক্ষণ এরই মধ্যে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্ট শিল্প থেকে। বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বা বিজিএমইএ বলছে এখন পর্যন্ত বিদেশি ক্রেতারা তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছে যাতে প্রায় ২০ লাখের বেশি শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, 'কোনো ক্রেতাই এখন শার্ট-প্যান্ট কিনবে না। কিনবে খাবার ওষুধ।' এমন পরিস্থিতিতে সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন অনেক গার্মেন্ট মালিক। রুবানা হক বলেন, এ সংকট থেকে বের হয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার মূলত ইউরোপ এবং আমেরিকাকেন্দ্রিক। কিন্তু করোভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সেসব দেশের বড় ব্যান্ডগুলো তাদের অর্ডার বাতিল কিংবা স্থগিত করেছে। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক প্রাইমার্ক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে তারা ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং অস্ট্রিয়াতে তাদের সব স্টোর অনিদির্ষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। শুধু ব্রিটেনজুড়ে তাদের প্রায় ২০০টি স্টোর রয়েছে। আরেকটি নামকরা ব্র্যান্ড জারা বিশ্বজুড়ে তাদের প্রায় চার হাজার স্টোর বন্ধ রেখেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে। বেসরকারি গবেষণাসংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুন বলেন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় করোনাভাইস সংক্রমণের বিষয়টি যত দীর্ঘায়িত হবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিও তত বেশি হবে। তিনি বলেন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক হিসেব দিয়েছে যে করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে বাংলাদেশের জিডিপির ১ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে তীব্র সংকটের যে হাতছানি দেখা যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমিকরা। বিজিএমইএর তালিকাভুক্ত প্রায় চার হাজার কারখানায় ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। গাজীপুরের একটি কারখানার একজন শ্রমিক বলেন, কাজ থাকবে কিনা সেটি ভেবে তার উদ্বেগ বাড়ছে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিভিন্ন নামকরা ব্র্যান্ড তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করে দেওয়ায় বেশ সংকটে পড়েছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গার্মেন্ট-শ্রমিক। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি আস্তর্জাতিক সংস্থা সেন্টার ফর গেস্নাবাল ওয়ার্কাস রাইটস মার্চ মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর ওপর একটি অনলাইন জরিপ করেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে এই খাত কতটা সংকোচে পড়েছে সেটি বোঝার চেষ্টা হয়েছে এই গবেষণার মাধ্যমে। এই গবেষণায় তারা তুলে ধরেছে, অনেক ব্র্যান্ড কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই তাদের অর্ডার বাতিল করেছে এবং সেক্ষেত্রে কাঁচামাল কেনার খরচও তারা দেয়নি। এ গবেষণায় বলা হয়েছে, 'বিশ্বজুড়ে তৈরি পোশাক সরবরাহের ওপর কোভিড-১৯ মহামারির মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার আগে এটি আরও খারাপের দিকে যাবে। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে লকডাউনের কারণে পোশাকের বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় পোশাকের চাহিদাও কমেছে। ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতারা তাদের বেশ দ্রম্নত তাদের অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে। এসব অর্ডারের ওপর ভিত্তি করে যেসব পোশাক কারখানা এরই মধ্যে উৎপাদন শেষ করেছে, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর দামও দিচ্ছে না ব্র্যান্ডগুলো।' তৈরি পোশাক শিল্পের সামনে আকস্মিক এমন বড় ধাক্কা আসবে সেটা কারো ধারণাতেই ছিল না। অনেকে ভেবেছিলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে ইউরোপ আমেরিকা হয়তো দ্রম্নত বেরিয়ে আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি হয়েছে এর উল্টো। অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে দীঘদিন ধরে কাজ করছেন জলি তালুকদার। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের মাঝে চাকরির নিশ্চয়তা নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে অনেকে বেশ মানসিক চাপের ভেতর দিয়ে দিন যাপন করছেন। জলি তালুকদার মনে করেন, শ্রমিকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'চাল, ডাল এবং তেলসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সমন্বয়ে শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে,' বলেন জলি তালুকদার। করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য প্রকোপ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে আসছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত দেশজুড়ে কার্যত লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু গার্মেন্ট কারখানা চালু রয়েছে। মালিকরা বলছেন, হাতে যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো সময়মতো শেষ করার জন্য কারখানা চালু রাখা জরুরি। এছাড়া কিছু কারখানা পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট তৈরি করছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। গার্মেন্ট খাতের সংকট মোকাবিলার জন্য সরকার এরই মধ্যে প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, সরকার যে ৫০০০ কোটি টাকা দিয়েছে সেটি শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, 'এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই টাকা শ্রমিকদের বেতনের জন্য ব্যবহার করা হবে।' যে প্রশ্নটি বেশি আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো-করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সব অফিস বন্ধ রাখা হলেও কেন গার্মেন্ট কারখানা খোলা রাখা হচ্ছে? লকডাউনের সময় অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও গার্মেন্ট কারখানা খোলা থাকবে কিনা সেটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মালিকদের ইচ্ছার ওপর। বিজিএমইএর একটি সূত্র বলছে, তাদের তালিকাভুক্ত কারখানার মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ কারখানা খোলা রয়েছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি মালিকপক্ষ উপেক্ষা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।