বাবুর্চি পরিচয়ের আড়ালে রাতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি

প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

তানভীর হাসান
নয়জনের দুর্ধর্ষ ডাকাতদল। প্রথমে তারা স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি নিয়ে হানা দেয় টার্গেট বাসায়। সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলায় দলের একজন ককটেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। লোকসমাগম দেখলেই সে ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে। এ সুযোগে পালিয়ে যায় সবাই। সংঘবদ্ধ এই ডাকাতদলের সদস্যরা দিনে এটা-সেটা করে। তাদের প্রায় অর্ধেকই বাবুর্চি হিসেবে পরিচিত। রান্নায় রীতিমতো সুখ্যাতি রয়েছে তাদের। তবে নিরীহ এই রাঁধুনীরাই রাতের বেলায় হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। দলের অন্য সদস্যের সঙ্গে মিলে তারা লুট করে টাকা-গহনাসহ মূল্যবান সামগ্রী। এই চক্রের ছয় সদস্যকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তারা সবাই আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে। তাদের দেওয়া তথ্যে উদ্ধার করা হয়েছে দুটি বাড়িতে ডাকাতির মালপত্র। এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তুরাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শেখ মফিজুল ইসলাম বলেন, ডাকাতদলটির সদস্যরা খুবই চতুর। তারা ডাকাতির জন্য একত্রিত হলেও পরস্পরের পরিচিত নয়। নিজেদের ব্যাপারে তারা বেশি তথ্য শেয়ার করে না। দলের দুজন হয়তো অপর দুজনকে চেনে, তবে তারা বাকিদের বিস্তারিত জানে না। এর ফলে দলের একজন ধরা পড়লেও বাকিদের নাম-ঠিকানা থাকে আড়ালে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, তুরাগ থানার একটি ডাকাতির মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এই চক্রটিকে শনাক্ত করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে তুরাগের বাউনিয়া এলাকায় নৌবাহিনীর সিভিল স্টাফ সাজ্জাদুর রহমানের বাসায় সাত-আটজন মুখোশপরা ডাকাত হানা দেয়। তারা দেশীয় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চেইন, কানের দুল ও আংটিসহ প্রায় চার ভরি স্বর্ণ এবং নগদ টাকা লুট করে। পালানোর সময় তারা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৫ জানুয়ারি তারা একই কায়দায় পলস্নবীর আলোবদিরটেক এলাকায় আরেকটি বাসায় ডাকাতি করে। এসব ঘটনায় তুরাগ ও পলস্নবী থানায় মামলা হয়। দীর্ঘ চেষ্টার একপর্যায়ে পুলিশের উত্তরা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুজ্জামান সরদারের নেতৃত্বে একটি দল ৯ ডাকাতকে শনাক্ত করে। এরপর ১০ মার্চ রাত থেকে শুরু হয় টানা অভিযান। রাজধানীর ভাটারা থেকে হান্নান সরদার, যাত্রাবাড়ী থেকে ফজলে সরদার, পশ্চিম আগারগাঁও থেকে খায়রুল, তুরাগের বাউনিয়া থেকে সোহরাব হোসেন কামাল ও মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান থেকে মা জুয়েলার্সের মালিক মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে সোহরাবের দেওয়া তথ্যে ভোলার চরফ্যাশন থেকে মাসুদ ওরফে ভোলা মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু স্বর্ণ ও ইমিটেশনের গহনা। এ ছাড়া ডাকাতিতে ব্যবহূত শাবল, বঁটি, মোবাইল ফোন ও নগদ টাকাও জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ডাকাতদলের সদস্যরা একেকজন একেক এলাকায় থাকে। নিজেদের এলাকায় কোন্‌ বাসায় ডাকাতি করা যাবে সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে। সোহরাব ১৫ বছর ধরে তুরাগের বাউনিয়ায় থাকে। বাউনিয়ার ডাকাতির ঘটনায় সে এজেন্ট বা তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করে। তবে নিজের এলাকা বলে সে ওই ডাকাতিতে সরাসরি অংশ নেয়নি। সে ও হান্নান একসঙ্গে বাবুর্চির কাজ করত। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তারা পরস্পরের পরিচিত। হান্নান থাকে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে। সে মাঝে কিছুদিন মেসের রান্না করে দিত। সর্বশেষ সে ৩০০ ফুট এলাকার একটি বিরিয়ানির দোকানে কাজ নেয়। আর সোহরাব বাবুর্চিগিরির পাশাপাশি জমির দালাল হিসেবেও কাজ করে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় থাকে ভোলা মাসুদ। সে, হান্নান ও সোহরাব বিভিন্ন জায়গায় বাবুর্চি হিসেবে কাজ করে। মাসুদ আবার কখনো রিকশাচালক, কখনো পিকআপ চালকের সহকারী হিসেবেও কাজ করে। সে পিকআপ চালক খায়রুলের সহকারী ছিল। খায়রুলকে সে-ই নিয়ে আসে ডাকাতদলে। খায়রুলের বাসা আগারগাঁও এলাকায়। রুবেল নামে দলের এক পলাতক সদস্যকেও খুঁজছে পুলিশ। সে গ্রেপ্তারকৃত ফজলের চাচাতো ভাই এবং দলের অন্যতম হোতা। ফজলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। গ্রেপ্তারকৃত মামুন ডাকাতদের কাছ থেকে কম দামে লুটের স্বর্ণ কিনে নিত। এরপর তা গলিয়ে অন্যদের কাছে বিক্রি করত। তার কাছ থেকে লুটের স্বর্ণ বিক্রির ১১ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। সে এর আগেও একাধিকবার এই চক্রের কাছ থেকে স্বর্ণ কিনেছিল বলেও স্বীকার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর, কালকিনি, ডাসারচর, শিবচর, ময়মনসিংহের ত্রিশাল, মানিকগঞ্জের সিংগাইর, গাজীপুরের শ্রীপুর, যশোরের নিউ মার্কেট, বিএমপির বন্দর থানাসহ বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ একাধিক মামলা রয়েছে।