স্ত্রী-দুই সন্তানকে হত্যার পর ভিক্ষুকের বেশ

প্রকাশ | ০৯ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে রাকিব -সংগৃহীত
রাজধানীর দক্ষিণখানে স্ত্রী ও দুই সন্তান হত্যা মামলার আসামি বিটিসিএল কর্মকর্তা রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ লিটনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর তিনি এই হত্যাকান্ডের কথা 'স্বীকার করেছেন' জানিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. মশিউর রহমান বলেছেন, পাওনাদারদের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেন বলে জানিয়েছেন রাকিব। এই হত্যাকান্ডের পর ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে 'নিজেকেও শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন'। তবে ট্রেন আসতে দেরি করায় তা হয়নি। পরে পাগল ও ভিক্ষুকের বেশ নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন রাকিব। মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বোনের বাসায় যাওয়ার পথে রাকিবকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর। গত ১৪ ফেব্রম্নয়ারি রাতে রাজধানীর দক্ষিণখানের প্রেমবাগানে একটি ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট থেকে গৃহবধূ মুন্নী রহমান (৩৭) এবং তার দুই শিশু সন্তান ফারহান উদ্দিন বিপস্নব (১২) ও লাইবার (৩) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত মুন্নী রহমানের বড় ভাই মুন্না রহমান দক্ষিণখান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় নিখোঁজ রাকিব উদ্দিন আহম্মেদকে। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর থানার ভাতশালী গ্রামে। উপ-কমিশনার মশিউর বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রাকিব জানিয়েছেন স্ত্রী মুন্নী, ছেলে ফারহান ও মেয়ে লাইবাকে নিয়ে দক্ষিণখানের ওই ভবনের চতুর্থ তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড-বিটিসিএলে কনিষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে উত্তরায় কর্মরত ছিলেন। সংসারে মাঝে মাঝে টুকটাক পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা হলেও সবাইকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে একত্রে বসবাস করছিলেন। 'অফিসের কলিগসহ অন্যান্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় এক কোটি ১৫ লাখ টাকা সুদের উপর বিভিন্ন সময়ে ধার নিয়েছিল। অনলাইনে জুয়া খেলে সে সব টাকা নষ্ট করে। এদিকে পাওনাদাররা তাদের পাওনা টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। এ কারণে সে বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের সাথে খারাপ আচরণ করত এবং গত ডিসেম্বর মাসে সে কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল। তখন তার পরিবার দক্ষিণখান থানায় জিডি করে। কিন্তু কিছুদিন পরে সে বাসায় ফিরে আসে। 'পাওনাদারদের টাকার চাপে সে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন সময় আলোচনা করলেও তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে তার জুয়া খেলার কারণে বিশ্বাস করত না। তখন পাওনাদারদের বিভিন্ন চাপের কারণে রাকিবের স্ত্রী মুন্নী ও তার ছেলে ফারহান তাকে বলে, এভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী? আমাদের কাউকে দিয়ে মেরে ফেল, এভাবে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। পাওনাদারদের চাপ, আত্মীয়-স্বজনদের অবিশ্বাস এবং স্ত্রী-সন্তানদের বিভিন্ন কথা তার অসহ্য লাগে।' জিজ্ঞাসাবাদে রাকিবের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউর বলেন, ১২ ফেব্রম্নয়ারি রাকিব, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা দেরিতে নাস্তা করেন। নাস্তা শেষে রাকিব স্ত্রীর সাথে গল্প করেন। গল্প শেষে সকাল আনুমানিক ১১টার দিকে মুন্নী হালকা ঘুমিয়ে পড়েন। ছেলে ফারহান পাশের রুমে মোবাইলে গেম খেলছিল, আর মেয়ে লাইবা পাশের এক রুমে টিভি দেখছিল। 'সে সময়ে হঠাৎ লিটনের মাথায় চিন্তা আসে যে, এই দুনিয়ায় সে তার পরিবারসহ বেঁচে থেকে লাভ কী বরং তাদের সবাইকে মেরে সে নিজে আত্মহত্যা করলে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সন্তানসহ সে নিজে পাওনাদার ও অন্যান্য দুনিয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।' 'তখনই সে তার পাশে থাকা হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে স্ত্রীর মাথায় আঘাত করে এবং গলা চেপে ধরে। তখন রাকিবের স্ত্রী তাকে বলে, তুমি আমাকে মারলে কেন, এ বলে সে নিস্তেজ হয়ে যায়। পরে লিটন টিভি রুমে গিয়ে কাপড়ের রশি দিয়ে মেয়ের গলা পেঁচিয়ে ধরে, মেয়ে মারা যাওয়ার পর আবার সে তার ছেলে ফারহানের রুমে যায়। ছেলে তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। মেয়েকে যে রশি দিয়ে মেরেছিল সেই রশি দিয়ে ছেলের গলায় পেঁচিয়ে ধরে। তখন ছেলে টের পেয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করে। 'এক পর্যায়ে ছেলে খাট থেকে নিচে পড়ে যায়। তখন লিটন ছেলের বুকের উপর চড়ে বসে এবং চাপ দিয়ে ধরে। তখন ছেলে বলতে থাকে, বাবা তুমি আমাকে মারতেছ কেন? আমার কী অপরাধ? এই বলে ছেলে লিটনের হাতের উপর আঁচড়াতে থাকে এবং ছেলের নখের আঁচড়ে লিটনের হাত কেটে যায়। এক পর্যায়ে লিটন ছেলেকে বলে, আমরা এ পৃথিবীতে কেউ থাকব না। আমরা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব বলে ছেলেকেও মেরে ফেলে।' এরপরে লিটন নিজেও 'আত্মহত্যার চেষ্টা করেন' জানিয়ে মশিউর রহমান বলেন, 'রাকিব বলেছে, স্ত্রী-সন্তানদের মেরে ফেলার পর সে নিজে নিজে বলতে থাকে, আমি পাপী, তোমরা নির্দোষ। তোমাদের পাশে আমি মরব না, আমি মরব রাস্তার পাশে বা রেললাইনের ধারে। যেন আমার লাশ শিয়াল-কুকুরে খায়। পরে সে বাসায় তালা দিয়ে বিকাল ৪টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রেললাইনে যায়। ট্রেনের নিচে পড়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ট্রেন না আসায় সে আত্মহত্যা করতে পারেনি। 'আত্মহত্যা করতে না পেরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষুক এবং পাগলের ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘুরতে থাকে।' মা ও দুই শিশুর লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি ডায়রি উদ্ধার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে পাঠানো হয়। সেই ডায়রিতে লেখা ছিল, 'আজ ১২ তারিখ। সবাইকে মুক্তি দিয়ে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান যেন কারও কাছে হেয় না হয়। আমাকে পাওয়া যাবে রেললাইনে।' সে সময় স্বজনরা জানিয়েছিলেন, ওই লেখা রাকিবের। অনলাইনে ব্যবসা করতে গিয়ে কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে মুক্তির পথ হিসেবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন তিনি।