শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাওড়ে বোরো ধান কাটা নিয়ে উদ্বেগে কৃষক

নূর মোহাম্মদ
  ১১ এপ্রিল ২০২০, ০০:০০

করোনায়ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন হাওড় অধু্যষিত সাত জেলার কয়েক হাজার কৃষক পরিবার। ধান কাটা শ্রমিকের অভাব ও পর্যাপ্ত মেশিন না থাকায় বোরো ধান কেটে গোলায় উঠাতে পারবে কিনা এ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তারা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটতে না পারলে অকাল বন্যা এবং পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাবে। একই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ধানের মূল্য কম পাওয়ার দুশ্চিন্তায়। এ অবস্থায় উচ্চ সুদে ঋণ পরিশোধসহ উৎপাদনের খরচ যোগাতে হিমশিত খেতে হবে কৃষকদের। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষকদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের খাদ্য সরবরাহের বড় অংশটি নিশ্চিত হয় বোরো ধানের মাধ্যমে। সরকারি গুদামে মজুতের মূল অংশটিও নির্ভর করে এ ফসল থেকে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে মূলত বোরো কাটা শুরু হলেও এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কিছুুটা দেরি শুরু হয়েছে। এবার বোরোতে ২ কোটি টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের একাংশের অন্তত আড়াইশ হাওড়ে বোরো আবাদ হয়। দেশের মোট বোরো ফসলের প্রায় ১৯ শতাংশ আসে এসব হাওড় থেকে। গত দুই বছর অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে উঠাতে পারেনি। এতে এক ফসলি জমির ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এবার কড়া সুদে ঋণ নিয়ে আবার সেই জমিতে আবাদ করে। এবার ফসল ঘরে উঠাতে না পারে তবে জমি বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কৃষকরা জানান, বোরো ফসল উঠিয়েই ধান বিক্রি করে ধান কাটার শ্রমিক, মাড়াই এবং ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এ সময় প্রতি বছর ধানের দাম একদম কম থাকে। এবার করোনার কারণে ধানের দাম আরও কমে যাওয়া শঙ্কা করছেন তারা। এমনটা যদি হয় তবে কৃষকরা এবারও ঋণে বোঝা কমাতে পারবেন না।

কিশোরগঞ্জের ইটনা ও ধইলং হাওরে প্রায় ২ হাজার মনের ফসল করেছেন বাচ্চু মিয়া। তিনি জানান, পুরো ধান কাটতে আমার প্রয়োজন চারজন শ্রমিক। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১২ জন ম্যানেজ করতে পেরেছি। ইতোমধ্যে বিআর-২৮ ধান পেকে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ ধান না কাটতে না পারলে ধান নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বাকি জাতের ধান আগামী দশ দিনের মধ্যে কেটে শেষ করতে হবে। না হয় হাওড়ে পানি চলে আসবে। এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ধান কাটার কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার দেওয়া হয়েছে। ধান কাটার পুরো সময়টুকুতে হাওড়ে উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, নিকলী এবং তাড়াইল ইউএনও এবং কৃষি কর্মকর্তারা সমন্বয় করে কাজ করবেন। তিনি বলেন, ধান কাটার জন্য জামালপুর, কুড়িগ্রামসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিকরা আসেন। যানবাহন বন্ধ থাকায় এবার একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে অনেক হাওড়ে বিকল্প পদ্ধতিতে শ্রমিকরা এসেছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে গত সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটের আওতায় হাওড় অঞ্চলের (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার সরবরাহের বরাদ্দ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে হাওড় অঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এছাড়া পুরানো মেরামতযোগ্য ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার অতিদ্রম্নত মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান বলেন, ধান কাটার শ্রমিক কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সেজন্য এবার আমরা অতিরিক্ত ধান কাটার যন্ত্রপাতি দিয়েছি। অন্যান্য জেলা থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিকরা যেন সমস্যা না পড়েন সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাওড় এলাকায় শ্রমিকরা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে প্রচুর শ্রমিক এখন গ্রামে অবস্থান করছেন। তারা এখন ধান কাটার কাজে অংশ নিতে পারবেন। তাই ধান উঠানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা রিপার ও হারভেস্টার কিনেছি। যন্ত্রপাতিগুলো হাওড়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় হাওড় শুকনা, কোনো কাদা নেই। তাই এই কমন হারভেস্টার বা রিপার দিয়ে ধান কাটতে কোনো সমস্যা হবে না। তাই শ্রমিককের ছাপ এবার একটু কম হলেও সমস্যা হবে না। আর পেস্নইন ল্যান্ডে বোরো ঘরে তুলতে সমস্যা হবে বলে জানান তারা।

কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালক ড. আবদুল মঈদ যায়যায়দিনকে বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ৫০ পার্সেন্ট পরিশোধের মাধ্যমে ধান কাটার মেশিন দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ধান কাটার শ্রমিক সংকট জটিল আকার দেখা দিলে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কৃষকদের ধান ঘরে তোলার স্বার্থেই সরকার হাওড়ের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতিমধ্যে হাওড়ে বাঁধগুলোর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। আশা করছি সুন্দরভাবেই কৃষক ঘরে ফসল তুলতে পারবে। তিনি বলেন, আগামী জুনের মধ্যে ৬৪ জেলায় তিন ক্যাটাগরির কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- কম্বাইন হারভেস্টর, রিপার এবং রাইস ট্রান্সপস্ন্যান্টার সরবরাহ করা হবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চার ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, সারাদেশে উৎপাদিত ধানের ১৮ শতাংশের বেশি আসে হাওড়াঞ্চল থেকে। কিন্তু কোনো রকম বন্যা হলেই ফসলগুলো তলিয়ে যায়। এতে পথে বসতে হয় কৃষকদের। এবার করোনাভাইরাসের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

হাওড় নিয়ে কাজ করেন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির গবেষণা সেল প্রধান আব্দুল আলীম বলেন, একটা বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে থাকেন হাওড়ের লোকজন। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তার মধ্যে এবার করোনাভাইরাস বোরো ফসলের তুলতে মারাত্মক সমস্যা হবে। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটতে না পারলে পানিতে তলে যাবে। হাওড়ে পানি প্রবেশ করতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই সময়ের মধ্যেই ধান কেটে ফেলা সম্ভব। সহজ শর্তে কৃষককে ধান কাটার মেশিন কিনতে সহায়তা করতে সরকারের দাবি জানান তিনি।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোলস্না বলেন, হাওড়াঞ্চলের কৃষকের প্রধান সমস্যা দু'টি। প্রথমত তারা সময় মতো বন্যার সঠিক পূর্বাভাস পায় না। দ্বিতীয়ত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার না করায় বন্যার সময় দ্রম্নত ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<95902 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1